ঝুলন্ত চিতাবাঘের দেহ। শনিবার পুরুলিয়ার দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রামে। — নিজস্ব চিত্র।
উত্তরবঙ্গের লোকালয়ে ঢুকে মাঝে মধ্যেই হামলা চালায় চিতাবাঘ। সে তুলনায় পুরুলিয়ায় বড় একটা হামলার খবর শোনা যায় না। কিন্তু উত্তরবঙ্গে যা হয়নি, শনিবার পুরুলিয়ার কোটশিলা থানার ঝাড়খণ্ড লাগোয়া দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রামে সেটাই হল। চারটে পা ও লেজ কেটে একটা চিতাবাঘের গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। মুষ্টিমেয় পুলিশকর্মীদের সামনেই এ সব চলল। পরে আরও পুলিশ গেলে তাঁদের লাঠি নিয়ে গ্রামবাসীরা বাধা দেন বলে অভিযোগ। চিতাবাঘটির হামলায় এক পুলিশ কর্মী-সহ আহত হন তিন জন।
পুরুলিয়ার ডিএফও ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘পূর্ণবয়স্ক মহিলা চিতাবাঘটি গ্রামে ঢুকে তিনজনকে জখম করে। তারপরেই বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। চারটি পা ও লেজ কেটে নেওয়া হয়। বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন ১৯৭২ মোতাবেক একটি মামলা রুজু করা হচ্ছে।’’ পরে বনকর্মীরা গ্রামে গিয়ে বাঘটিকে উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়। এ দিকে বাঘের হামলায় জখম এক পুলিশ কর্মী ও দুই গ্রামবাসীকে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ধর্মদাস কুমার নামে এক প্রৌঢ়ের আঘাত গুরুতর।
এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রামের একটি পুকুরের ঝোপে প্রথমে এক মহিলা বাঘটিকে দেখতে পান। তিনি চিৎকার করে লোকজনকে ডাকতেই বাঘটি লাফ দিয়ে পাশের একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে পাশের পবন কুমারের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। গৃহকর্তার উঠোনে তিনটি ছাগলকে সামনে পেয়ে বাঘটি তাদের মারে। পবনবাবুর কথায়, ‘‘কাছে জঙ্গল থাকলেও আমাদের এলাকায় আগে চিতাবাঘ ঢোকেনি। বাঘটা ছাগলগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার সুযোগে আমি স্ত্রী ও ছেলেপিলেদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিই। ততক্ষণে বাড়ির আশপাশে জড়ো হওয়া লোকজনের চিৎকারে বাঘটা আমাদের বাথরুমে ঢুকে যায়।’’ তিনিই ফোন করে খবর দেন পুলিশ ও বনকর্মীদের।
ততক্ষণে পাশের নুতনডি, অযুডি, বারবেন্দ্যা, বেড়াডি, উত্তর টাটুয়াড়া, মাঝি টাটুয়াড়া, দুলমি প্রভৃতি গ্রাম থেকে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ পবন কুমারের ঘরের সামনে জড়ো হয়ে যান। জনা কয়েক পুলিশ এলে তাঁদের মধ্যে শ্রীমন্ত তন্তুবায় নামে এক কনস্টেবল বাথরুমের ভিতরে উঁকি মারতে যান। তাঁর কথায়, ‘‘দেওয়ালে উঠতে যেতেই বাঘটা লাফ দিয়ে বাইরে এসে পড়ে। থাবার নখে আমার পিঠের অনেকখানি কেটে যায়।’’ বাইরে জটলার মধ্যে বাঘের সামনে পড়ে যান স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের ছেলে যুবক প্রেমচাঁদ কুমার। বাঘটি ঝাঁপাতেই হাতের লাঠি বাগিয়ে ধরেন প্রেমচাঁদ। কিন্তু বাঘের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারেননি। ততক্ষণে লাঠি নিয়ে বাঘের দিকে তেড়ে যান ওই গ্রামেরই বাসিন্দা প্রৌঢ় ধর্মদাস কুমার। হাসপাতালে তিনি বলেন, ‘‘আমার দু’টো হাত থাবা দিয়ে চেপে ধরেছিল বাঘটা। ঘাবড়ে গেলেই বাঘটা আমাকে মেরে ফেলবে জানতাম। কপালের উপর একটা থাবা বসাতেই আমিও ওকে চেপে ধরলাম। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি চলার পরে বাঘটা কিছুটা কাবু হয়ে যায়।’’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাসিন্দাদের একাংশ বাঘটিকে মেরে থাবা ও লেজ কেটে নেয়। তারপর একটি নিমগাছে ঝুলিয়ে দেয়। খবর পেয়ে আরও পুলিশ গেলে বাধার মুখে পড়েন। পরে তাঁদের বুঝিয়ে পুলিশ গ্রামে ঢোকে। এরপর বনকর্মীরা গ্রামে যান। যদিও বাসিন্দাদের দাবি, আত্মরক্ষার্থে তাঁরা বাঘটিকে মেরেছেন। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য বাদলচন্দ্র কুমারও বলেন, ‘‘জনতাই ইট-পাটকেল ছুঁড়ে, লাঠি দিয়েই বাঘটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে বলে শুনেছি। তা নাহলে বাঘটা আরও অনেককে জখম করত।’’ পুরুলিয়ার ডিএফও-র প্রশ্ন, ‘‘আত্মরক্ষার্থে মারলে চিতার পা ও লেজ কেটে নেওয়া হল কেন?’’ বন দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘শুধু ওই এলাকা নয়, রাজ্যে এমন নৃশংস ভাবে চিতাবাঘ মেরে ফেলা নজিরবিহীন।’’