ভিখারি অন্তর্ধান রহস্য ৩

জেরায় মুখ না খোলাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভিখারির

ভিখারি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে প্রথম প্রচারে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিক্টোরিয়া জুটমিলের ঠিকাকর্মী ভিখারি পাসোয়ানের নিখোঁজের ঘটনায় পরিবারের পাশে দাঁড়ান তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী। রাজ্য–রাজনীতিতে ভিখারির ঘটনায় আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে মমতার তেলেনিপাড়ায় ঢোকা নিয়ে প্রশাসন নানা পদক্ষেপ করলেও মমতা নিষেধ মানেননি। কিন্তু কী হয়েছিল ভিখারির...? তার তদন্তের পরিণতিই বা কী হল? খোঁজ নিল আনন্দবাজার। ১৯৯৩ সালের পর ভিখারি অন্তর্ধান নিয়ে বাম সরকরের বিরুদ্ধে বিরোধীদের লাগাতার অন্দোলন চলছিলই। ঘরে বাইরে নানা ভাবে চাপ বাড়তে থাকায় প্রাথমিকভাবে সরকার বিষয়টিকে উপেক্ষার রাস্তা নেয়। ভাবনায় ছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনও মিইয়ে যাবে। তবে পুরো বিষয়টির উপর সরকারি নজরদারি ছিলই।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৬ ০১:৪০
Share:

১৯৯৩ সালের পর ভিখারি অন্তর্ধান নিয়ে বাম সরকরের বিরুদ্ধে বিরোধীদের লাগাতার অন্দোলন চলছিলই। ঘরে বাইরে নানা ভাবে চাপ বাড়তে থাকায় প্রাথমিকভাবে সরকার বিষয়টিকে উপেক্ষার রাস্তা নেয়। ভাবনায় ছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনও মিইয়ে যাবে। তবে পুরো বিষয়টির উপর সরকারি নজরদারি ছিলই।

Advertisement

কিন্তু বিধি বাম। যা ভাবা গিয়েছিল, হল তার উল্টো। আন্দোলনের চাপ বাড়তেই থাকল। মানুষের আস্থা ফেরাতে শেষ পর্যন্ত স্বপন নামহাট্টা, সমর দত্ত এবং আরও এক পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ করা হয়। অভিযোগ, এই তিনজনই ভিখারিকে ঘটনার রাতে বাড়ি থেকে তুলে এনেছিলেন। এরপর দাবি বাড়তেই থাকে। এমন প্রশ্নও ওঠে, কে‌ন নীচুতলার পুলিশ কর্মীদের নিশানা করছে সরকার? আইপিএস অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হরমনপ্রীত সিংহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জোরদার হতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ঠেকাতে জেলার কোথাও তাঁকে পাঠানো হলে তিনি সাধারণ মানুষের ‘টার্গেট’ হতে থাকেন। উড়ে আসতে থাকে নানা আপত্তিকর মন্তব্য।

অবস্থা সামাল দিতে, সরকারি স্তরে সিদ্ধান্ত হয় আইপিএসদের বিধিবদ্ধ প্রশিক্ষণ নিতে হরমনকে বিদেশে পাঠানো হবে। এতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পাশপাশি বিষয়টিতেও ইতি টানা যাবে।

Advertisement

কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল উল্টোটাই। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ভিখারিকে খুঁজে বের করতে সিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতিহাসের এমনই সমাপতন যে, আজ রাজ্যের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা সারদা এবং নারদ কান্ডে বিরোধীদের সিবিআই তদন্ত চাওয়া নিয়ে নানা কু-কথা বলছেন। অথচ সেদিন লড়াকু যুবনেত্রী কিন্তু আদালতের কাছে সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উপরেই আস্থা রেখেছিলেন।

কী উঠে এসেছিল সিবিআই তদন্তে?

ভিখারিকে খুঁজে বের করতে বা তার পরিণতি কী হয়েছিল তা জা‌নতে চেষ্টার কসুর করেনি সিবিআই। এসপি পদমর্যাদার এক অফিসারকে মাথায় রেখে শুরু হয় তদন্ত। ততদিনে সংসারের একমাত্র রোজগেরেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় পাসোয়ান পরিবারের হাঁড়ির হাল। মমতার নির্দেশে আকবর সর্বক্ষণ তখন ওই পরিবারের পাশে থেকেছেন। সিঙ্গুরের মতোই মমতা তেলেনিপাড়ায় সরকারের উপর চাপ বাড়াতে অনশনেও বসেন। ভিখারি অন্তর্ধান পর্বে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান হয়। আন্দোলনে জয়ের আশায় মমতাই তার নাম দিয়েছিলেন ভিক্ট্রি পাসোয়ান। আন্দোলন মঞ্চে সেই ঘোষণা করে ভিখারির ভাই কানাইয়ের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ভিখারির স্ত্রীও চটকলে কাজ পান।

সিঙ্গুরের মতোই সেই সময় মমতার নিয়মিত গন্তব্য ছিল তেলেনিপাড়া। একবার ঝড়বৃষ্টির রাতে অন্য কর্মসূচি সেরে মমতা কলকাতায় ফেরার পথে আকবরের কাছে খবর পান ভিখারির বাবা লক্ষ্মীচাঁদ অসুস্থ। সোজা গাড়ি ঘুরিয়ে তেলেনিপাড়ায় ভিখারির বাড়িতে হাজির হন তিনি। অত রাতে মমতার হঠাৎ আগমনে তেলেনিপাড়ার জুটমিল মহ‌ল্লার অপরিসর গলিতে মানুষের ভিড়ে পুলিশের তখন নাকানি-চোবোনি অবস্থা।

কিন্তু সাত ম ণ তেল পুড়লেও রাধাকে নাচতে দেখা যায়নি। ভিখারির হদিস দিতে সিবিআই কার্যত ব্যর্থ হয়। সেই রাতে ভিখারির সঙ্গে কী ঘটেছিল?

সিবিআই আদালতে জানিয়েছিল, ঘটনার রাতে গামছা পরা অবস্থায় ভিখারিকে চুঁচুড়ার খাদিনা মোড়ের কাছে ধরমপুর ফাঁড়িতে তুলে আনে পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দেহরক্ষী বলরাম সিংহকে তেলেনিপাড়ায় কারা পিটিয়ে মারে পুলিশ তাঁর কাছে বারবার জানতে চায়। পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে যেহেতু ভিখারি কাজ করতেন, তাই পুলিশের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এই বিষয়টি তাঁর না জানার কথা নয়। কিন্তু ওই ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে ভিখারি বার বার দাবি করায় পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল, পরিচিত জনকে বাঁচানোর তাগিদেই সত্য গোপন করছেন ভিখারি। শুরু হয় অত্যাচার। ভিখারিকে পা উপর দিকে করে ঝোলানো হয়। পুলিশের ধারণা ছিল, ভয়ে হয়তো সব বলে দেবেন ভিখারি। কিন্তু পরিচিত পুলিশ অফিসারদের এমন আচরণে আহত ভিখারির জেদ চেপে যাওয়ায় মুখে কোনও রা-ই কাড়েননি তিনি। তখনই তলপেটে চলে বুটের পর পর লাথি! উল্টোভাবে ঝুলন্ত অবস্থাতেই ভিখারি ঝিমিয়ে পড়লে তাঁকে নামিয়ে চোখেমুখে জল দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও সাড়া না দেওয়ায় পদস্থ কর্তারা ঘাবড়ে যান। চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে পুলিশের বিশ্বস্ত ময়না-তদন্তকারী এক চিকিৎসককে তখনই ধরমপুর ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়। তিনি পুলিশকর্তাদের জানিয়ে দেন, কিছুক্ষণ আগেই ভিখারির মৃত্যু হয়েছে। এতেই মাথায় বাজ পড়ে পুলিশকর্তাদের। পুরো বিষয়টি কী ভাবে ধামাচাপা দেওয়া হবে তা নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। পরে বাঁশবেড়িয়ায় ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে নিয়ে যাওয়া হয় ভিখারির দেহ। মাঝিদের সহায়তায় ভিখারির শরীরে তার জড়িয়ে তার সঙ্গে থান ইট বেঁধে মাঝগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়।

এ সব তথ্যই সিবিআই পর্যবেক্ষণ হিসাবে আদালতে লিপিবদ্ধ করেছিল। যদিও এর স্বপক্ষে কোনও তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষী-সাবুদ আদালতে হাজির করানো যায়নি। ফলে মামলাও ধোপে টেঁকেনি। তাই ভিখারি পাসোয়ানের অন্তর্ধান রহস্যেই ঢাকা থেকে গিয়েছে এখনও।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement