(উপরে) শুক্রবার পূর্ণমকে নিয়ে মিছিলে রিষড়ার চেয়ারম্যান বিজয়সাগর মিশ্র এবং বিধায়ক অরিন্দম গুঁইন। শনিবার পূর্ণমকে পদ্মের মালা পরাচ্ছেন বিজেপি নেতারা (নীচে)। ছবি: সংগৃহীত।
দু’বছর আগে রামনবমীকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক হিংসায় খাক হয়েছিল যে জনপদ, সেখানেই এখন জাতীয়তাবাদের স্রোত বইছে! দু’বছর আগে এপ্রিল মাসে ভয়ে কুঁকড়ে যে গিয়েছিল মহল্লা, সেখানেই এখন ব্যান্ডপার্টির তালে উৎসবের মেজাজ।
সে জনপদের নাম হুগলির রিষড়া। আর যাঁকে ঘিরে ২০২৫ সালের মে মাসে উৎসব হচ্ছে সেখানে, তিনি পাকিস্তানের খপ্পর থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম কুমার সাউ। ঘরে ফিরেছেন শুক্রবার। তার পর থেকেই তাঁকে নিয়ে রাজনীতির দড়ি-টানাটানি শুরু হয়েছে। যা শনিবারেও অব্যাহত। বিষয় একটাই— জাতীয়তাবাদের ইজারা নেবে কে? তৃণমূল না বিজেপি?
শুক্রবার দুপুরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছন পূর্ণম। তার পরে গুচ্ছগুচ্ছ মালা পরানো হয় তাঁকে। কিন্তু সেখানে বেশি সময় যায়নি। হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়ি ছোটে রিষড়ার দিকে। তবে বাড়িতে নয়। গাড়ি থামে জিটি রোডের উপর বাগখালে। বিএসএফ জওয়ানের ছবি-সংবলিত বিশাল তোরণের সামনে থেকে শুরু হয় মিছিল। হুডখোলা জিপের এক দিকে দাঁড়ানো পূর্ণম। গলায় মালার গুচ্ছ। গায়ে জড়ানো জাতীয় পতাকা। জিপে পূর্ণমের একপাশে দাঁড়ানো তৃণমূল পরিচালিত রিষড়া পুরসভার চেয়ারম্যান বিজয়সাগর মিশ্র আর অন্যপাশে চাঁপদানির বিধায়ক তথা তৃণমূলের হুগলি-শ্রীরামপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অরিন্দম গুঁইন। মানুষের স্রোত এগিয়ে গিয়েছে সাউ সদনের (পূর্ণমদের বাড়ির নাম) দিকে। মিছিলে তৃণমূলের দলীয় পতাকা ছিল না। কিন্তু জমায়েত যে শাসকদলের সংগঠিত ছিল, সে ব্যাপারে স্থানীয় কারও সন্দেহ নেই। যুক্ত হয়েছিল সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততাও। একান্ত আলোচনায় তৃণমূল নেতারা মানছেন, তাঁরা পূর্ণমের ঘরে ফেরাকে ‘ইভেন্ট’ করে তুলতে চেয়েছিলেন। যাতে বিজেপি ‘দখল’ নিতে না-পারে।
তবে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে বিজেপি ‘হার’ মানবে কেন? শুক্রবার তৃণমূলের আতিশয্য এবং অতি সক্রিয়তায় পূর্নমের আশেপাশে ঘেঁষতে না-পারলেও শনিবার সকালে সটান সাউ সদনে চলে যান বিজেপির তিন বিধায়ক বিমান ঘোষ, অম্বিকা রায় এবং সুব্রত ঠাকুর। সঙ্গে এলাকার বিজেপি নেতা প্রণয় রায়। পূর্ণমকে পদ্মফুলের মালা পরিয়ে দেন বিজেপি নেতারা। বিএসএফ জওয়ানের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলানো হয় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরও। শুভেন্দু জানিয়ে দেন, তিনিও পূর্ণমের সঙ্গে দেখা করতে সাউ সদনে যাবেন।
প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূল এবং বিজেপি-র কেউই আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘জাতীয়তাবাদের ইজারা’ নেওয়ার কথা মানেনি। তৃণমূল বিধায়ক অরিন্দমের বক্তব্য, ‘‘আমরা ওখানে রাজনীতি করতে যাইনি। গত এক মাস ওই পরিবার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সেই সময়ে আমরাই তাঁদের পাশে ছিলাম। তাই শুক্রবার তাঁদের আনন্দের মুহূর্তেও শামিল হয়েছিলাম।’’ আবার বিজেপি-র বিধায়ক বিমানের কথায়, ‘‘এটা আগের ভারত নয়। এখনকার ভারত। বীর জওয়ানকে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার পরে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।’’
এর মধ্যে অবশ্য বাম-কংগ্রেসের নেতারাও সাউ সদনে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সফর সেই ‘অভিঘাত’ তৈরি করতে পারেনি। সেই প্রয়াস ঘটনাপ্রবাহে নিতান্তই ভেসে থাকার চেষ্টা বলে মনে করছেন স্থানীয়েরা। যেমন তাঁরা মনে করছেন, মূল ইজারার লড়াই হচ্ছে তৃণমূল বনাম বিজেপি-র।
ঘটনাচক্রে, পহেলগাঁওয়ে নিহত বাংলার পর্যটক বিতান অধিকারীর স্ত্রীর ক্ষেত্রেও নিয়েও একই রকম ‘সক্রিয়’ ছিল যুযুধান দুই শিবির। বিতানের স্ত্রী সোহিনীকে শুভেন্দুরা নিজেদের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছেন বলে অভিমত অনেকের। সোহিনীর বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। তা নিয়ে জলঘোলা হওয়ায় সোহিনীকে ভারতের নাগরিকত্বও দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গুঞ্জন, সোহিনী বিজেপির দলীয় মঞ্চেও যেতে পারেন। পক্ষান্তরে, বিতানের বৃদ্ধ বাবা-মার ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়াস নিয়েছিল রাজ্য সরকার। তাঁদের পেনশনের বন্দোবস্তও করে দেওয়া হয় সরকারের তরফে। তবে বিতানের ক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যেও বিভাজন স্পষ্ট ছিল। সাউদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। পূর্ণমের পরিবার দু’পক্ষের সঙ্গেই আগাগোড়া ‘সমন্বয়’ রেখেছিল।
রিষড়ায় বিপুল পরিমাণ অবাঙালি হিন্দুর বসবাস। বড় অংশের অ-বাংলাভাষী মুসলিমরাও থাকেন এই এলাকায়। ফলে ‘মেরুকরণের ক্ষেত্র’ তৈরি হয়েই রয়েছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক ভাবে এই ‘স্পর্শকাতর’ এলাকায় জমি শক্ত করতে চেয়েছে দু’পক্ষই। উপলক্ষ পূর্ণম। উদ্দেশ্য অভিন্ন।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী জানিয়েছে, পহেলগাওঁয়ে জঙ্গি হামলার পরদিন, গত ২৩ এপ্রিল পঞ্জাবের পঠানকোটে কর্মরত অবস্থায় ভুলবশত পাকিস্তান সীমান্তে ঢুকে পড়ে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন পূর্ণম। তখনই পাক রেঞ্জার্স তাঁকে ধরে। সীমান্তে এমন ঘটলে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে ‘ফ্ল্যাগ মিটিং’-এর পরে সংশ্লিষ্ট জওয়ানকে মুক্তি দেওয়াই দস্তুর। কিন্তু পহেলগাঁও-পরবর্তী উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পূর্ণমকে তখন ছাড়েনি পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত গত সপ্তাহের বুধবার পাক সেনা মুক্তি দেয় তাঁকে। বিনিময়ে ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা-পড়া এক পাক রেঞ্জারকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
অটারী-ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ফেরেন পূর্নম। প্রায় সেই একই সময়ে সেই সীমান্ত পেরিয়েই পাকিস্তানে ফিরে যান ধৃত পাক রেঞ্জার। দেশে ফেরার পরে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিলেও তখনই বাড়ি ফেরার অনুমতি পাননি পূর্ণম। তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়। বেশ কিছু সরকারি কাজকর্মও ছিল। সে সব মেটার পরে বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র পান ওই বিএসএফ জওয়ান।
গত ২৩ এপ্রিল থেকেই সাউ পরিবারের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ রেখে গিয়েছিল তৃণমূল। শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিএসএফ-এর ডিজি-র সঙ্গে পূর্ণমের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বার ফোনে কথা বলেছিলেন জওয়ানের পরিবারের সঙ্গে। পরিবারের সঙ্গে দু’বেলা সমন্বয় রাখছিলেন পুরসভার চেয়ারম্যান বিজয়সাগর। সমান্তরাল চেষ্টা জারি রেখেছিল বিজেপি-ও। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু পূর্ণমদের বাড়িতে গিয়েছেন। ফোনেও যোগাযোগ রেখেছিলেন পদ্মশিবিরের নেতারা। কিন্তু রিষড়ার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের গত এক মাস ধরে শাসক তৃণমূলের ‘অতি সক্রিয়তা’ই নজর কেড়েছে। কড়া ‘ম্যান মার্কিং’-এ রাখা হয়েছে পূর্নমকে। শনিবার সকালে বিজেপি বিধায়কেরা যাওয়ার পরে সন্ধ্যায় সাউ সদনে যাচ্ছেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ।
দু’বছর বছর আগে হিংসার সময়ে দু’পক্ষ একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছিল। দু’বছর পর সেই জনপদেই জাতীয়তাবাদের ইজারা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে সেই দু’পক্ষ। জনপদের নাম রিষড়া।