বিপন্ন পুলিশ/১

থানায় চড়াও তৃণমূল, ছাড়তেই হল অভিযুক্তকে

তৃণমূলের দাদাগিরিতে পিছু হটল পুলিশ। ডাকাতিতে অভিযুক্ত এক তৃণমূল নেতাকে ধরেও শাসক দলের কর্মী সমর্থকদের চাপে রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকী, সকালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশের তরফে জানানো হলেও রাতে জেলার পুলিশ সুপার দাবি করলেন, ওই নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেবল আটক করা হয়েছিল।

Advertisement

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য ও রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজগঞ্জ (জলপাইগুড়ি) শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০৩:২৫
Share:

তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রায় এবং অভিযুক্ত নেতা মনোরঞ্জন দাস

তৃণমূলের দাদাগিরিতে পিছু হটল পুলিশ। ডাকাতিতে অভিযুক্ত এক তৃণমূল নেতাকে ধরেও শাসক দলের কর্মী সমর্থকদের চাপে রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকী, সকালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশের তরফে জানানো হলেও রাতে জেলার পুলিশ সুপার দাবি করলেন, ওই নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেবল আটক করা হয়েছিল।

Advertisement

শনিবার রাতে জলপাইগুড়ির ফাটাপুকুর এলাকায় সুধীররঞ্জন ধাড়া নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি হয়। এলাকার তৃণমূল নেতা মনোরঞ্জন দাসের বিরুদ্ধে ডাকাতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগও পুলিশের কাছে দায়ের করে ওই ব্যবসায়ী পরিবার। সেই মতো সেই রাতেই ধরা হয় মনোরঞ্জনবাবুকে। রবিবার সকালে মনোরঞ্জনবাবুকে প্রিজন ভ্যানে তুলে আদালতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করে রাজগঞ্জ থানার পুলিশ। কিন্তু তত ক্ষণে ওই থানা চত্বর ঘিরে ফেলেছিলেন তৃণমূলকর্মীরা। বেলা গড়াতে চলে এসেছিলেন রাজগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক খগেশ্বর রায়ও। তখন প্রায় হাজার দুয়েক তৃণমূল সমর্থক হাতে দলের পতাকা নিয়ে মুহুর্মুহু ‘দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ থানা ঘিরে রেখেছেন। শেষপর্যন্ত পুলিশ মনোরঞ্জনবাবুকে আদালতে নিয়ে যেতে পারেনি। তাঁকে আবার থানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এমনকী, তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়নি বলে দাবি করেন জেলা পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া। তিনি দাবি করেন, “কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলব না।” কিন্তু গ্রেফতার করা না হলে মনোরঞ্জনবাবুকে কেন আদালতেনিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্যানে তোলা হয়েছিল, তা নিয়ে পুলিশ কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। থানা চত্বরে দলের পতাকা নিয়ে হাজির তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সরানোরও কোনও চেষ্টা পুলিশ দৃশ্যত করেনি। রাত পর্যন্ত ওই থানা ঘিরে রাখেন তৃণমূলকর্মীরা। তারপরেই পুলিশ মনোরঞ্জনবাবুকে ছেড়ে দেয়। রাজগঞ্জের ওসি সনাতন সিংহ বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল। ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁকে আবার ডাকা হবে।’’

Advertisement

২০১১ সালের অক্টোবরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের সময় গণ্ডগোলের জেরে ধৃত তৃণমূল কর্মীদের ছাড়াতে থানায় চলে গিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকে বেশ কয়েকবার তৃণমূলের নেতারা থানায় গিয়ে চড়াও হয়েছেন। পুলিশকে হেনস্থাও করা হয়েছে বারবার। এ দিনও থানা ঘিরে রেখে তৃণমূলকর্মীরা দাবি করেন, মনোরঞ্জনবাবুকে দুপুরের মধ্যেই ছেড়ে দিতে হবে। তা করতে না পারায় দলের কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন খগেশ্বরবাবুও। সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত টানা থানায় বসে থাকেন বিধায়ক। দুপুরের পরে বিশাল পুলিশবাহিনী থানায় চলে এলেও, তৃণমূলের সমর্থকদের সরাতে কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ।

মনোরঞ্জনবাবু তৃণমূলের রাজগঞ্জ ব্লকের সুখানি অঞ্চল কমিটির সহ-সভাপতি। তিনি এলাকায় হাতুড়ে চিকিৎসাও করেন বলে দাবি। এলাকায় তিনি মানু ডাক্তার নামেই পরিচিত। তাঁর স্ত্রী এ দিন থানা চত্বরের সামনে দাবি করেন, ‘‘ঘুম থেকে তুলে মারধর করে পুলিশ আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে আসে।’’

সুধীরবাবু পাইকারি ব্যবসায়ী। শনিবার রাতে ফাটাপুকুর লাগোয়া ধারাপাড়ায় তাঁর বাড়িতে অন্তত পনেরো জনের ডাকাত দল দু’রাউন্ড গুলি চালিয়ে যথেচ্ছ বোমা ছুড়ে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা এবং বেশ কয়েক ভরি সোনার অলঙ্কার করে লুঠপাট করে পালায় বলে অভিযোগ। ডাকাতদের হামলায় চার জন জখম হন। দু’জনকে শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেই পুলিশ অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে। তারপর থেকেই পুলিশের উপর তৃণমূল নেতৃত্বের প্রভাব খাটানোর শুরু বলে অভিযোগ।

তৃণমূল অবশ্য দাবি, স্থানীয় বাসিন্দারাই এই দিন থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর অবশ্য বক্তব্য, “ধৃত ব্যক্তিকে ছাড়াতে থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানো সমর্থন করি না। ঘটনার খবর পেয়ে বিধায়ককে থানায় পাঠিয়েছিলাম। তাঁকেও হেনস্থা করা হয়েছে।’’ সৌরভবাবুর দাবি, ‘‘ধৃত ব্যক্তির গ্রামের লোকজন বিক্ষোভ দেখায়। আমরা বলেছি আইন আইনের পথে চলবে।’’ তবে সৌরভবাবুর সংযোজন, ‘‘পুলিশকে তদন্তের সুযোগ দিতে হবে।” খগেশ্বরবাবুর যুক্তি, ‘‘সকাল থেকে একদল লোক থানায় বিক্ষোভ দেখায়। খবর পেয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে থানায় যাই।”

কিন্তু সুখানি গ্রামের তৃণমূল যুব সভাপতি জাহাঙ্গির আলমকে এ দিন দলের পতাকা হাতে থানার সামনে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে। পাশে ছিলেন ওই অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁদের অভিযোগ, জমি সংক্রান্ত পুরনো বিবাদের জেরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মনোরঞ্জনবাবুকে ফাঁসানো হয়েছে। এ দিন যাঁরা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তাঁদের মুড়িও দেওয়া হয়েছিল।

মনোরঞ্জনবাবু এই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ব্যবসায়ী সুধীরবাবুও তাই। সুধীরবাবুর পরিবার সূত্রে খবর, ডাকাতেরা মুখে কালি মেখে এসেছিল। ঘটনার পরে সন্দেহবশত এক জনের নাম-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

তবে সুধীরবাবুর বাড়িতে ডাকাতির খবর পেয়ে এ দিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। তাই এই ঘটনায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রকাশ্যে এসে পড়েছে বলে দাবি করেছেন বিরোধীরা। তৃণমূল অবশ্য সেই দাবি অস্বীকার করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন