(বাঁ দিকে) রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ আগরওয়াল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা (এসআইআর) নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা আক্রমণ শানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা নিশানা করেছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) মনোজ আগরওয়ালকে। কিন্তু শুক্রবার তৃণমূলের মুখপত্রের প্রভাতী সংস্করণে মমতার সেই সংক্রান্ত কোনও বক্তব্যই প্রকাশিত হয়নি। বরং তৃণমূলের বিরোধী সিপিএম তাদের মুখপত্রের প্রথম পাতায় শুক্রবার মমতার সাংবাদিক বৈঠকের প্রতিবেদন ‘গুরুত্ব’ দিয়ে প্রকাশ করেছে। দু’দলের মুখপত্রের এমন অপ্রত্যাশিত অবস্থান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
মমতা ওই সাংবাদিক বৈঠকেই এসআইআর-কে ‘এনআরসি-র ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। যা তিনি আগেও বলেছেন। সে দিনই অসম সরকারের তরফে নদিয়ার দু’জনকে এনআরসি-র নোটিস পাঠানোর কথা প্রকাশ্যে আনেন মমতা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী প্রশ্ন তোলেন, কী ভাবে অসম সরকার এই নোটিস পাঠাতে পারে? সেই প্রসঙ্গেই তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে আক্রমণ করেন। তৃণমূলের মুখপত্রে মমতার বক্তব্যের সেই অংশটি প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সিইও সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের এক ছত্রও প্রকাশিত হয়নি। যা প্রত্যাশিত নয়। যা সাধারণত হয়েও থাকে না। মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত বক্তব্যই দলীয় মুখপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হবে, সেটাই দস্তুর। যেমন প্রত্যাশিত যে, সিপিএমের মুখপত্রে মমতার খবর ‘বিস্তারিত’ থাকবে না। শুক্রবার যুযুধান দুই দলের মুখপত্রে ‘উলটপুরাণ’ ঘটেছে।
কেন তৃণমূলের মুখপত্র রাজ্যের সিইও সম্পর্কে মমতার বক্তব্য এক বর্ণও ছাপাল না? কেনই বা ‘গুরুত্ব’ দিয়ে সেই মন্তব্য প্রকাশ করল রাজ্য সিপিএমের মুখপত্র? আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলের মুখপত্রের সম্পাদক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় শনিবার বলেন, ‘‘আমরা আমাদের কাগজে কী ছাপব, সেটা আমরাই ঠিক করব। তা নিয়ে কাউকে কিছু বলব না।’’ সিপিএমের মুখপত্রের সম্পাদক তথা প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘সংবিধানের নামে শপথ নিয়েই উনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) মুখ্যমন্ত্রী। সেই তিনিই রাজ্য সরকারের সচিবালয় থেকে আক্রমণ করছেন এক জন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাকে। তাঁর সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু এটা করা যায় না। মমতার মুখোশ খুলতেই আমরা ওই প্রতিবেদন গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছি।’’
এ অবশ্য দু’দলের দুই মুখপত্রের দুই সম্পাদকের ‘আনুষ্ঠানিক’ বক্তব্য। নেপথ্যের কারণ কী? শাসক তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘সিইও মনোজ সম্পর্কে দিদি যদি রাজনৈতিক সভা থেকে ওই কথা বলতেন, তা দলীয় মুখপত্রে লেখা যেত। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছে নবান্নে। সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তাই বিষয়টি সরকারি মোড়কে হয়েছে। সে কারণেই মনে হয় দলীয় মুখপত্র খবরটা এড়িয়ে গিয়েছে। নথিভুক্ত রাখেনি।’’
তৃণমূল যেমন এসআইআর-এর বিরোধিতা করছে, তেমন এর বিরোধিতা করছে সিপিএম-ও। বিহারে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী যে ‘ভোট অধিকার যাত্রা’ করেছিলেন, তার সূচনা এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠানে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির সমস্ত প্রথম সারির নেতার মতো সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক এমএ বেবিও হাজির ছিলেন। আবার তৃণমূল তাদের প্রতিনিধি হিসাবে সমাপ্তি অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছিল বহরমপুরের সাংসদ ইউসুফ পাঠানকে। কম সময়ে যে ‘কায়দায়’ নির্বাচন কমিশন এসআইআর করতে চাইছে, রাজ্যে তারও বিরোধী সিপিএম। আবার তারা তৃণমূলেরও বিরোধী। ফলে তাদের অবস্থা খানিকটা ‘শাঁখের করাতে’ পড়ার মতো হয়েছে। কিন্তু দলীয় মুখপত্রে মমতার বক্তব্যকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হল কেন? দলের এক পলিটব্যুরোর সদস্যের বক্তব্য, ‘‘আমাদের অনুমান, নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মমতার সুর বদলাবে। তিনি কমিশনের সঙ্গে জেলা ধরে দর কষাকষিতে যাবেন। তেমনকিছু হলে আমরা এই প্রতিবেদনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে করতে পারব।’’
বৃহস্পতিবার বিকালে ওই সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা। তৃণমূলের মুখপত্রের একটি দৈনিক সান্ধ্য সংস্করণ আছে। সেখানেও সিইও মনোজকে মমতার আক্রমণ সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি। মনোজ সম্পর্কে মমতা বলেছিলেন, ‘‘এখন যিনি সিইও, তাঁর বিরুদ্ধেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সময় হলে বলব!’’ মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ ছিল, সিইও বিভিন্ন আধিকারিকদের ‘হুমকি’ দিচ্ছেন। মমতার সেই কথা ধরেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সোমবারের মধ্যে যদি সিইও-র বিরুদ্ধে কী দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তা প্রকাশ না-করেন মুখ্যমন্ত্রী, তা হলে তিনি রাজ্য সরকারের অন্য আমলাদের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ’ প্রকাশ্যে আনবেন। কমিশনও গোটা ঘটনাপ্রবাহে ‘অসন্তুষ্ট’ বলে খবর। সিইও-র বিরুদ্ধে যখন মুখ্যমন্ত্রী ওই বক্তব্য পেশ করছেন, তখন মুখ্যসচিব কী ভাবে সেখানে হাজির রইলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ গড়া হয়েছিল। পটনা এবং মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’র প্রথম দু’টি বৈঠকের পরে তৃণমূলের মুখপত্র যেমন সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অধুনা প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরির ছবি ছাপেনি, তেমনই সিপিএমের মুখপত্রও ছবি থেকে বাদ দিয়েছিল মমতাকে। কিন্ত বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছর এসআইআর নিয়ে সিইও-কে মমতার হুঁশিয়ারির ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটল। এসআইআর নিয়ে মমতার বক্তব্য এডি়য়ে গেল তাঁর দল তৃণমূলের মুখপত্র। আর প্রথম পাতায় প্রতিবেদন প্রকাশ করল সিপিএমের প্রভাতী দৈনিক!