Abhishek Banerjee

দুই কন্যার বিবাহ: সুন্দরবনের ‘সাহসিনী’দের সংবর্ধনায় সাহসী আখ্যান তৃণমূলের, উপলক্ষ সমলিঙ্গে বিবাহ, লক্ষ্য বিজেপি

গত সপ্তাহেই সুন্দরবনের কুলতলির প্রত্যন্ত গ্রামের দুই তরুণী রিয়া এবং রাখী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সোমবার ফোনে তাঁদের শুভেচ্ছা জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝিয়ে দিলেন সমলিঙ্গ বিবাহে তৃণমূলের অবস্থানও।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ১৪:১৫
Share:

কুলতলিতে সোমবার সংবর্ধনা দেওয়া হয় সুন্দরবনের নববিবাহিত যুগলকে। ফোনে তাঁদের শুভেচ্ছা জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের রিয়া এবং রাখীকে বিবাহের শুভেচ্ছা জানালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত সপ্তাহেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজার থানা এলাকার রিয়া সর্দার এবং কুলতলি ব্লকের বকুলতলার বাসিন্দা রাখী নস্কর। সোমবার তাঁদের এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলিতে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল তৃণমূল। সেই সভা চলাকালীনই ফোনে দুই তন্বীকে শুভেচ্ছা জানান তৃণমূলের নেতা অভিষেক। বলেন, “সুন্দরবনের মাটি থেকে এক অনন্য ইতিহাস রচিত হয়েছে।”

Advertisement

সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে সমাজের ছুতমার্গের ঊর্ধ্বে ওঠার জন্যও সুন্দরবনবাসী তথা গোটা রাজ্যবাসীকে বার্তা দেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক। তিনি বলেন, “আমাদের সমাজের চেনা ছকের বাইরে গিয়ে ভালবাসার সত্যিকারের অর্থকে সামনে এনেছে রিয়া ও রাখী। তারা প্রমাণ করেছে, ভালবাসা কখনও কোনও বন্ধনে বা কোনও সীমারেখার মধ্যে আটকে থাকে না। ভালবাসা কোনও বাধা মানে না। না ধর্মের, না লিঙ্গের, না জাতির, না সমাজের, না নিয়মের।”

সোমবারের ঘটনা অবশ্য শুধু সুন্দরবনের নববিবাহিত যুগলকেই শুভেচ্ছা জানানোর জন্যই নয়। সেটি উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য বিজেপি। লক্ষ্য সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে তৃণমূলের দলীয় অবস্থানও। বস্তুত, সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে রাজ্যের শাসকদলের শীর্ষনেতৃত্বের প্রকাশ্যে এমন ‘বলিষ্ঠ’ অবস্থান সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রথম। বিজেপি বা বিজেপি-ঘেঁষা দলগুলি এ বিষয়ে সামাজিক অবস্থান অনেকটাই ‘রক্ষণশীল’। এ বিষয়ে তাদের ছুতমার্গ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেও এসেছে। এমনকি, সংসদেও বিজেপি সদস্যেরা সমলিঙ্গ বিবাহের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের নেতা বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, তাঁরা এই ‘গোঁড়ামি’তে বিশ্বাসী নন। অভিষেকের কথায়, ‘‘রিয়া এবং রাখীর সাহস, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা এবং ভালবাসা আগামী কয়েক প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁরা গোটা সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভালবাসা মানেই মানবতা এবং মানবতাই হল সমাজের আসল পরিচয়।’’

Advertisement

‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে অভিষেকের শুভেচ্ছাবার্তার নির্যাস হল— ভালবাসার মধ্যে ধর্ম বা জাতি বা লিঙ্গ কোনও প্রতিকূলতা তৈরি করতে পারে না। উত্তর ভারতের হিন্দিবলয়ে, বিশেষত বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে প্রায়শই ভিন্‌ধর্মে বা ভিন্‌জাতে বিয়ে করার জন্য হেনস্থার শিকার হওয়ার অভিযোগ ওঠে। অনেকেই মনে করছেন, সমলিঙ্গ বিবাহকে দলীয় ‘স্বীকৃতি’ দেওয়ার পাশাপাশি ভিন্‌ধর্মে বা ভিন্‌জাতে বিবাহ প্রসঙ্গেও তৃণমূল তাদের অবস্থান দৃঢ় ভাবে বুঝিয়ে দিল।

সোমবার একেবারেই আঞ্চলিক স্তরে তৃণমূলের তরফে রিয়া-রাখীর সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কুলতলির বিধায়ক গণেশচন্দ্র মণ্ডল, মথুরাপুরের সাংসদ বাপি হালদার এবং অন্য স্থানীয় নেতৃত্বেরা নববিবাহিত যুগলকে সংবর্ধনা দেন। এ-ও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ যে, আঞ্চলিক স্তরের একটি কর্মসূচিতে ফোন করে শুভেচ্ছা জানালেন অভিষেক। সেই শুভেচ্ছাবার্তার ভিডিয়ো নিজের সমাজমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করেন তিনি। পরে ওই সংবর্ধনা সভার বেশ কিছু ছবি-সহ একটি দীর্ঘ পোস্ট করেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। কুলতলিবাসীর উদ্দেশে ফোনে অভিষেক জানান, শীঘ্রই তিনি ওই গ্রামে যাবেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেবেন। ওই গ্রামের উন্নয়নের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব পদক্ষেপ করা হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

যা থেকে স্পষ্ট যে, আঞ্চলিক এক সংবর্ধনা সভাকে এ ভাবে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসে সামাজিক তো বটেই, রাজনৈতিক স্তরেও ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন অভিষেক। তৃণমূল যে সমলিঙ্গ বিবাহকে আরও আপন করে নিয়ে ‘রক্ষণশীল’ পদ্মশিবিরের বিপরীতে একটি ‘উদার’ রাজনৈতিক মঞ্চ এই প্রান্তিক শ্রেণির জন্য খুলে দিতে চায়, সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।

ঘটনাচক্রে, গত বছর আরজিকর আন্দোলনের সময়ে পথে নেমেছিলেন প্রান্তিক লিঙ্গের একটি বড় অংশের মানুষ। তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক ভাবে ‘বামঘেঁষা’। সোমবারের ফোনে সেই প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের প্রতিও তৃণমূলের অবস্থানও বোঝানোর উদ্যোগ রয়েছে। রিয়া-রাখীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অভিষেক ফোনে বলেন, “দু’জনেই হয়তো জানত, কাজটা খুব সহজ হবে না। সমাজ থেকে নানা রকম বাধাবিপত্তি, প্রতিকূলতা আসবে। কটাক্ষ আসবে। তা-ও তারা একসঙ্গে থাকার লড়াই থেকে পিছিয়ে আসেনি। আমি তাদের কুর্নিশ জানাই।”

ওই যুগলের পাশে থেকে তাঁদের উৎসাহিত করার জন্য গ্রামবাসীদেরও ধন্যবাদ জানান অভিষেক। তাঁর কথায়, এটি শুধু কুলতলি বা দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা বাংলার গর্ব নয়, এটি গোটা দেশের গর্ব। গ্রামবাসীদের উদ্দেশে অভিষেক বলেন, “আপনারা সমাজের পুরনো মানসিকতার গণ্ডি ভেঙে ভালবাসার এই যাত্রায় রিয়া এবং রাখীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটি কেবল দু’টি মানুষের বিবাহ নয়। এটি আমাদের গ্রামের গর্ব। কুলতলির গর্ব। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গর্ব। বাংলার গর্ব এবং দেশের গর্ব। এটা বাংলার প্রত্যেক মানুষের মানবিকতা এবং ভালবাসার জয়। আমরা গর্বিত যে এই গ্রামের মানুষ এই ভালবাসাকে উৎসাহিত এবং হ়ৃদয় থেকে গ্রহণ করেছেন। পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙে আপনারা মানবিকতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আপনারা প্রমাণ করেছেন, সুন্দরবনের মানুষ শুধু প্রকৃতির সন্তান নয়, হৃদয়ের দিক থেকেও অনেক বড় মানুষ।” সুন্দরবন থেকে এই ইতিহাস তৈরি করার জন্য গ্রামবাসীদের ধন্যবাদ জানিয়ে তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা বলেন, রিয়া এবং রাখীর এই সাহস, মানবতা এবং ভালবাসা যাতে গোটা বাংলার প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে পড়ে।

যুগলকে অভিষেক বলেন, “তোমাদের ভালবাসা যেন আরও গভীর হয়, আরও দৃঢ় হয়। তোমাদের জীবন যেন আনন্দে, সম্মান, সম্প্রীতি ও শান্তিতে ভরে ওঠে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement