উৎসবের মেজাজ কামারহাটিতে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি। তাই খুশি হলেও একদম হইচই চাইছেন না তিনি। শুক্রবার বিকেলে জামিনের খবর পেয়ে সহবন্দিদের কাছে এমনটাই বলেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। উল্লাসের বাড়াবাড়ি চাইছেন না তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বও। কর্মী-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস সামলাতে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তাই স্পষ্ট নির্দেশ, ‘‘অতি উৎসাহে ওঁর বিপদ ডেকে আনবেন না।’’ এতে রাতের দিকে উল্লাসে কিছুটা রাশ টানা গেলেও, ভক্তকুলের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস ঠেকাবে কে! অনেকেই জানিয়ে দিলেন, পুজো শুরু হয়ে গেল তাঁদের!
বৃহস্পতিবার আলিপুর আদালতে জামিনের আর্জি জানিয়েছিলে মদন। তা নিয়ে শুনানির পর এ দিন রায় ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর আর্জি বিচারক মেনে নেবেন— এটা যেন আশা করেননি জেলবন্দি নেতা। তাই আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের মন্দির ওয়ার্ডে বসে যখন সুখবরটা পেলেন, তখন কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন। পরক্ষণেই অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে সহবন্দিদের মুচকি হেসে বললেন, ‘বাঃ, খুব ভাল। আমি খুব খুশি।’ তার পরেই একটা দীর্ঘশ্বাস, ‘২০১৪ সালের পুজোয় হাসপাতালে ছিলাম। তার পর গ্রেফতার হই। এ বার ‘মা’ চাইলে পুজোয় বাড়িতে থাকতে পারব। এটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।’
ওই পর্যন্তই। তার পরে চিৎ হয়ে সেলের খাটে শুয়ে পড়েন প্রাক্তন মন্ত্রী। ততক্ষণে জেলের বাইরে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। সবার একটাই আবদার, ‘‘এক বার অন্তত ‘দাদা’র সঙ্গে দেখা করতে দিন।’’ কিন্তু কোথায় ‘দাদা’। তিনি কারও সঙ্গে দেখা করবেন না— কড়া চোখে ভিড়ের উদ্দেশে জানিয়ে দিলেন কর্তব্যরত কারারক্ষীরা।
বন্দিজীবনে বহু বার জামিনের আর্জি জানিয়েছেন। এক বারই মাত্র সে আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন নিম্ন আদালতের বিচারক। কিন্তু সেই মুক্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দিন কয়েকের মধ্যে হাইকোর্টে জামিন নাকচ হয়ে যাওয়ায় ফের জেলে ঢুকে যেতে হয় তাঁকে। এ বার তাই বাড়তি ঝুঁকি নিতে চান না। ইতিমধ্যে মদনের কানে এসেছে, আগামী সোমবারই কলকাতা হাইকোর্টে জামিন বাতিলের আবেদন করতে পারে সিবিআই। তাই সতর্ক মদন ‘প্রভাবশালী’ তকমা এড়াতে আপাতত ঘরবন্দি হয়েই থাকতে চান।
তিনি বা তাঁর দলের নেতারা যা-ই চান না কেন, জামিনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভবানীপুরে কাঁসারিটোলায় তখন অত্যুৎসাহী সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে আবির খেলতে শুরু করে দিয়েছেন। সবুজ আবিরে উৎসবের চেহারা নিয়েছে তাঁর পুরনো বিধানসভা এলাকা কামারহাটিও। টিভি ক্যামেরার সামনে ‘বাইট’ দেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। মদনের সমর্থকেরা সমস্বরে বলে চলেছেন, ‘‘আমাদের পুজো আজ থেকেই শুরু হয়ে গেল।’’ পুত্রবধূ স্বাতী মিত্র বাড়ি ফিরে বললেন, ‘‘বাবা জেলে রয়েছে বলে ছেলের (মহারূপ) অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান এখনও করা হয়নি। বাবা ফিরলে সেটা এ বার হবে।’’
মদনের বাড়ির সামনে মেরাপ পড়েছে ভবানীপুর অগ্রদূত উদয় সংঘের পুজোর। বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে তাঁর ছবিওয়ালা পেল্লাই সাইজের ব্যানার। তাতে লেখা, ‘আমি জ্যোৎস্নার ভিতরে বসে এক কাঁথা বুনি, লাল-নীল-হলুদ সুতোয় সর্বক্ষণ’। পথচলতি মানুষের মনে হতে পারে এটা মদন মিত্র উবাচ। ওই ব্যানারের নীচে দাঁড়িয়ে পুজো কমিটির কর্তা স্বপন রায়। কপালে সবুজ আবিরের টিপ। বললেন, ‘‘দাদা ফিরলে দেখবেন, পুজোর সাইজ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।’’
তবে এখানেও উৎসব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ, জামিন নিয়ে কোনও ‘বাড়াবাড়ি’ না করার জন্য তখন জেল থেকে দূত মারফৎ নির্দেশ পাঠিয়েছেন ‘দাদা’। অতএব, সন্ধে নামতেই কাঁসারিটোলায় মদনের বাড়ির সামনের ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করে।
বিধানসভা ভোটের ফল বেরনোর দিন সারা বাংলা জুড়ে যখন উৎসব চলছিল, উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে সবুজ আবির মাখামাখি চলছিল হাজারো মুখে, কামারহাটিতে সে দিন অকাল-অন্ধকার নেমে এসেছিল মদনের পরাজয়ে।
এ দিন প্রিয় নেতার জেল থেকে মুক্তির উৎসব যেন সুদে-আসলে উসুল করে নিতে চাইলেন কামারহাটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। সন্ধে হতেই সেখানে ‘অকাল দেওয়ালি’। সারা মুখে সবুজ আবির মেখে হাতেই তুবড়ি ফাটিয়ে ফেলেছেন কামারহাটির তৃণমূল নেত্রী লক্ষ্মী বিশ্বাস। হাতে বরফ ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘‘দাদার জয়ের আনন্দের কাছে এই যন্ত্রণা তুচ্ছ।’’
জামিন পেয়েও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন মদন। কিন্তু প্রিয় নেতার মুক্তির আশায় এ দিন দুপুরেই দল বেঁধে আলিপুর জেল আর আদালতের সামনে পৌঁছে যান কামারহাটির গোপাল সাহা, বিমল সাহা, বিশ্বজিৎ সাহা, নবীন ঘোষাল, বিশ্বজিৎ গণ, দেবাশিস মহাপাত্র, সুবীর বসু-সহ বেশ কয়েক জন কাউন্সিলর ও অনুগামীরা। বাদ যাননি রাজীব ঘোষ, অভিজিৎ চাকলাদারের মতো কামারহাটি-বেলঘরিয়ার বিভিন্ন পুজো কমিটির কর্তারাও। এই সব পুজো কমিটির মাথায় রয়েছেন মদন। সন্ধেয় তাঁরা প্রত্যেকে এলাকায় ফিরে উৎসব শুরু করে দেন। কামারহাটি লোহাগেট, রথতলা, ফিডার রোড, এমবি রোড— সর্বত্র মিছিল বের হয়। আতসবাজির শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। পাশাপাশি নজরে আসে উচ্ছ্বাসে রাশ টানার চেষ্টাও। সমর্থকদের বোঝাচ্ছেন স্থানীয় নেতারা, বাড়াবাড়ির দরকার কী? মানুষটা বাড়ি ফিরছেন এটাই বড় কথা। যদিও সেই বাড়ি ফেরাটা কবে হবে সেটাই জানেন না তাঁরা! কারণ, জামিনের শর্ত হিসেবে আদালত বলেছে, ভবানীপুর থানা এলাকার বাইরে যাওয়া চলবে না। অথচ মদনের ভবানীপুরের বাড়িটি আদতে কালীঘাট থানা এলাকায়। ফলে জমিন পেয়ে জেল থেকে বেরোতে পারলেও আদালতের নির্দেশ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফেরার উপায় নেই মদনের!