মুখ্যমন্ত্রীর সাধ মেটাতে গিয়ে নিমের দায়ে বিকোচ্ছে ভাঁড়ার

রাজধানী দিল্লির রাস্তার ধারে ধারে নিমগাছের সারি। সে সৌন্দর্যে মুগ্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসনা, এ রাজ্যেও পথের পাশে পাশে নিমগাছের দল মাথা তুলুক। প্রকল্প রচনা হতেও দেরি হয়নি। মমতা স্বয়ং তার নামকরণ করেছেন— নিম বনানী। মুখ্যমন্ত্রীর সাধ পূরণে একটি বণিকগোষ্ঠী এগিয়ে এসেছে। সরকারকে এক লক্ষ নিমের চারা জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

চারা এসেছে সত্তর হাজার টাকার। তা লাগাতে গিয়ে ১৭ লক্ষ টাকা গলে গেল! চারাগুলো শেষমেশ গাছ হবে কি না, তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ।

Advertisement

সব মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘নিম বনানী’ ঘিরে ঘনিয়েছে সংশয়ের জাল।

রাজধানী দিল্লির রাস্তার ধারে ধারে নিমগাছের সারি। সে সৌন্দর্যে মুগ্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসনা, এ রাজ্যেও পথের পাশে পাশে নিমগাছের দল মাথা তুলুক। প্রকল্প রচনা হতেও দেরি হয়নি। মমতা স্বয়ং তার নামকরণ করেছেন— নিম বনানী। মুখ্যমন্ত্রীর সাধ পূরণে একটি বণিকগোষ্ঠী এগিয়ে এসেছে। সরকারকে এক লক্ষ নিমের চারা জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।

Advertisement

এবং প্রথম ধাপে বন দফতরের হাতে ৩৩ হাজার নিমের চারা দেওয়াও হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ৭০ হাজার টাকা। এর জন্য সরকারকে কোনও দাম দিতে হয়নি। তা হলে খরচটা হল কীসে?

দফতরের খবর: ওই ৩৩ হাজার চারা লাগাতে নদিয়ার কল্যাণী, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়, হাওড়ার জয়পুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঝড়খালি ও আলিপুরদুয়ারের গোপীমোহন চা-বাগানে মোট ৩১ হেক্টর জায়গা খুঁজে বার করতে হয়েছে। জমি জোগাড়, তা তৈরি করা, চারা রোপণ, সার দেওয়া ও চারার চারপাশে বেড়া বানানোর মতো বিবিধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে এ পর্যন্ত ১৭ লক্ষ টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। বাকি ৬৭ হাজার চারা লাগানোর কথা ভেবে বন-কর্তাদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা।

বাঙালির নিমপ্রীতি অবশ্য নতুন কিছু নয়। অনেকের বিশ্বাস, বাড়ির চৌহদ্দিতে নিমগাছ থাকলে হাওয়া শুদ্ধ হয়। বছরভর খাবার পাতে নিমপাতার আলাদা ইজ্জত। বাংলা সাহিত্যের আনাচ-কানাচেও নিমের বাতাস। বনফুলের ছোটগল্পে বাড়ির নিমগাছের সঙ্গে মিশে গিয়েছে পরিবারের লক্ষ্মীমন্ত বৌটি। যুগ যুগ ধরে নিমের প্রতি এত টান থাকলেও নিমচারা লাগাতে কর্তারা এত নিমরাজি কেন?

কারণ, খরচের বহর। বন দফতরের একাংশের দাবি, বণিকগোষ্ঠীটি নিমচারা লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, তাই কার্যত এটা তাদেরই প্রকল্প। ‘‘বেসরকারি সংস্থার প্রস্তাবিত প্রকল্পে জনগণের করের টাকা খরচ হবে কেন?’’— প্রশ্ন উঠেছে দফতরের অন্দরে। এই মহলের আশঙ্কা, প্রকল্পের খরচ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শেষমেশ আধিকারিকদের ঘাড়েই দায় এসে চাপবে।

ফলত দফতরের মাথারা বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট বণিকগোষ্ঠীর দাবি: প্রকল্পটি রাজ্য সরকারের, বাস্তবায়িত করছে বন দফতর। তারা শুধু চাহিদামতো চারা সরবরাহ করেছে বিনামূল্যে। এর বাইরে ‘নিম বনানী’তে তাদের কোনও ভূমিকা নেই বলে বণিকগোষ্ঠীর তরফে জানানো হয়েছে।

এ তো গেল প্রকল্পের দায়ভার ঘিরে বিভ্রান্তি। বন-কর্তাদের অনেকের মতে, পরিকল্পনার গোড়াতেও গলদ বিস্তর। কী রকম?

ওঁদের ব্যাখ্যা: চারা লাগানোর পর্ব জুলাই, বড়জোর অগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলা উচিত। কেননা চারা বেড়ে ওঠার জন্য বৃষ্টি জরুরি, সঙ্গে চাই বাতাসে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্প। জুলাই-অগস্টের ওই সময়ে দু’টোই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অথচ ‘নিম বনানী’ ঘোষণাই হয়েছে গত ২৯ জুলাই। খুঁটিনাটি স্থির করতে করতে অগস্ট পার। শেষমেশ সেপ্টেম্বরে চারা রোপণ শুরু হয়। এ দিকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় এ বার সেপ্টেম্বরে তেমন বৃষ্টি মেলেনি। ফলে মাটিতে পোঁতা ইস্তক নিমচারার দল রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে।

সমস্যার এখানেই শেষ নয়। চারার সুরক্ষা নিয়েও মহা সঙ্কট। কারণ, গোয়ালতোড় ছাড়া প্রকল্পের বাকি সব জায়গায় নিমচারা লাগানো হয়েছে বনাঞ্চলের বাইরে। সেগুলোর তেতো পাতা গরু-ছাগলে মুড়োচ্ছে না ঠিকই, তবে মুড়িয়ে নিচ্ছে মানুষ। ‘‘গাঁ-গঞ্জের লোক সকালে উঠে সরকারি নিমের ডাল ভেঙে দিব্যি দাঁত মেজে নিচ্ছেন। গাছ বাড়বে কী করে?’— আক্ষেপ এক বন-কর্তার। ওঁরা জানাচ্ছেন, ৩১ হেক্টরের অনেকটাই বনাঞ্চলের বাইরে থাকায় বনকর্মীদের নজরদারি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আলাদা রক্ষী বসানোর মতো লোকবল বা টাকার জোরও দফতরের নেই।

পরিণামে ‘নিম বনানী’ বিপর্যয়ের মুখে। বনকর্তাদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, চারা যতই রুগ্‌ণ হোক, বাঁচানোর উপায় রয়েছে। অসুস্থ সদ্যোজাতদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে যেমন সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) গড়ে উঠেছে, তেমন নিমচারা বাঁচানোরও উপায় হতে পারে বলে ওঁদের দাবি। যা শুনে আধিকারিকদের অনেকের পাল্টা কটাক্ষ, ‘‘একেই তো ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়েছে। এ বার চারা বাঁচাতে বিশেষ ব্যবস্থা করতে গেলে মনসার মন্দিরও বিকিয়ে যাবে।’’

এ সব সমস্যা যে হতে পারে, সেটা ওঁরা আগে জানাননি কেন?

দফতর সূত্রের ইঙ্গিত, উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছিল, মুখ্যমন্ত্রীর সাধের প্রকল্প বাস্তবায়িত করতেই হবে। তাই প্রশ্ন তুলে কেউ বিপদ ডে়কে আনতে চাননি। বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মনের কথায়, ‘‘আমাদের লক্ষ্য, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়িত করা। সব দফতরের মাথায় তো উনি-ই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন