বাবার শেষ ইচ্ছা রাখতে হাসপাতালেই বিয়ে মেয়ের

অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, ‘‘নিশ্চিন্ত হলাম। শান্তিতে থেকো তোমরা। ছোট ভাই-বোনকে দেখো।’’ দুই তরুণ-তরুণীর চোখে তখন জল। ঘরে হাজির চিকিৎসক-নার্সরাও ধরে রাখতে পারেননি চোখের জল।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:০৯
Share:

মেয়ের বিয়ের নথিতে এ ভাবেই সই করেন শ্যামলকুমার হারা। নিজস্ব চিত্র

পেনটা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তবু সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা হাতকে ইশারায় ‘না’ করলেন। হাসপাতালের বিছানায় বসে কাঁপা হাতে সই করার পরেই রোগে, যন্ত্রণায় কালো হয়ে যাওয়া শীর্ণ মুখে কেমন একটা শান্তির আলো ছড়িয়ে পড়ল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর ছেলেটির চার হাত এক করে নিজের মুঠোয় নিলেন। অস্ফুট উচ্চারণে বললেন, ‘‘নিশ্চিন্ত হলাম। শান্তিতে থেকো তোমরা। ছোট ভাই-বোনকে দেখো।’’ দুই তরুণ-তরুণীর চোখে তখন জল। ঘরে হাজির চিকিৎসক-নার্সরাও ধরে রাখতে পারেননি চোখের জল।

Advertisement

সম্প্রতি বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে বড় মেয়ে বীণার বিয়ের রেজিস্ট্রির নোটিসের কাগজে সই করলেন মৃত্যুপথযাত্রী ক্যানসার রোগী শ্যামলকুমার হারা। কন্যাদানের মতো করেই মেয়ের হাত দিলেন হবু জামাই সুরজিৎ সেনগুপ্তের হাতে। বাড়ির লোক অবশ্য শ্যামলবাবুকে জানিয়েছিলেন, এই সই মানেই রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল। কারণ তাঁরা জানতেন, নোটিস পিরিয়ড শেষ হওয়া পর্যন্ত শ্যামলবাবু থাকবেন না। এটুকু মিথ্যে দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রীকে যতটা আনন্দ দেওয়া যাবে, তা অমূল্য। হলও তাই। ন’দিন পরে, ১৩ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের শয্যায় নিথর হয়ে গেলেন শ্যামলবাবু।

দেরিতে হলেও মরণাপন্ন রোগীদের শেষের ক’দিনের মানসিক ও শারীরিক যত্ন বা ‘এন্ড অফ লাইফ কেয়ার’-এ এই মানসিক শান্তি দেওয়ার বিষয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসককেরা। ভারতে এর পথিকৃৎ কেরল। পশ্চিমবঙ্গে শুরুটা দেরিতে হলেও মানুষ এর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন বলে দাবি একাধিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞের।

Advertisement

শ্যামলবাবুর চিকিৎসক প্রব্রাজ্য নারায়ণ মহাপাত্র ব্যাখ্যা করছিলেন, রোগীর হাতে বেশি দিন নেই জানার পরে তাঁকে তা বোঝানো জরুরি। তেমনই জরুরি তাঁর ব্যাঙ্ক-ইনসিওরেন্সের কাগজ, সম্পত্তি-উইল বাড়ির লোককে গোছাতে বলা। এই প্রস্তুতির সময়টা না পেলে তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েন। ‘‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে এখনও ‘এন্ড অফ লাইফ কেয়ার’ বিষয়টি রোগীর শরীরের যন্ত্রণা কমানোতেই সীমাবদ্ধ।’’—বলছিলেন প্রব্রাজ্যবাবু। একই মত ক্যানসার চিকিৎসক অর্ণব গুপ্তের। তিনি বলেন, ‘‘শেষের ক’দিন শারীরিক যন্ত্রণা কমানোর পাশাপাশি রোগীকে বাড়িতে রাখা, মানসিক ভাবে আনন্দে রাখার উপরে বেশি জোর দিই। কিছু সুসংবাদ দেওয়া, তাঁর কোনও অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে বলা হয় বাড়ির লোককে।’’

শ্যামলবাবুর ক্ষেত্রেও মানসিক শান্তি দেওয়ার চেষ্টাটাই করেছেন পরিজনেরা। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়েই জগৎ ছিল বছর ৫৮-র শ্যামলবাবুর। গত মাসে হঠাৎ জানা যায়, শেষ পর্যায়ের যকৃতের ক্যানসার। তার পর থেকেই সন্তানদের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বড় মেয়ের বিয়ের দিয়ে যেতে না পারার আক্ষেপ তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন বীণা আর সুরজিৎ। এগিয়ে আসেন চিকিৎসকেরাও।

ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েক বছর আগের এক যুগলের কথা। দু’জনেরই ক্যানসার ধরা পড়েছিল। মেয়েটির ক্যানসার ছড়িয়েছিল বেশি। হাসপাতালেই বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। পরে স্বামীর কোলে মাথা রেখে মারা গিয়েছিলেন নববধূ, ইচ্ছাপূরণের শান্তি নিয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন