নজরদারি চলছে। মোহনগঞ্জে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
পাচারের আবার নির্দিষ্ট কোনও সময় আছে নাকি!
শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে নিতে হয় পাচারের কৌশল। আর সেটাই পাচারকারীদের মোক্ষম মাস্টারস্ট্রোক!
কালবৈশাখীর কথাই ধরা যাক। বিকেলের ঠিক আগে আগেই সীমান্তের নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো করা হয় গরু। যেই ধুলো উড়িয়ে ঝড় শুরু হয় ঠিক সেই সময়ে গরু নিয়ে একছুটে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ। বর্ষায় বড় আড়াল পাটখেত। লম্বা পাটগাছের আড়ালে বিএসএফের নজর এড়িয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় সীমান্তের ওপারে। আর শীতে পাচারকারীদের মোক্ষম অস্ত্র কুয়াশা।
এ তো গেল সময়ের কথা। পাচারের কথা মাথায় রেখে বদলে যায় পাচারকারীদের বাহনও। কী রকম? সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, সীমান্ত এলাকায় গরু নিয়ে আসা হয় বড় ট্রাকে। পুলিশ কিংবা বিএসএফ একটু কড়া হলেই সেই বড় ট্রাক উধাও হয়ে যায়। শুরু হয় ‘পেপসি’-র রমরমা। পেপসি কী? রানিনগর সীমান্তের এক বাসিন্দা রীতিমতো হতাশ, ‘‘আরে বাবা, ছোট গাড়িগুলোকেই তো এ দিকে সবাই পেপসি বলে।’’
বর্ষা পড়তেই অবশ্য সীমান্তের উদ্দেশে বড় ট্রাক, পেপসি সবই ছুটছে জেলা পুলিশের কোনও ‘মেজদা’-র নির্দেশে। আবার ধাঁধা। মেজদা কে? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘এই বয়সে চাকরিটা খোয়াতে চাই না। তবে মেজদার কথা বললে জেলা পুলিশের কোনও অফিসারের ক্ষমতা নেই সেই গাড়ি আটকানোর। এর বেশি আর কিছু বলা যাবে না। অসুবিধা রয়েছে।’’
মুর্শিদাবাদের রানিনগর পাচারের সৌজন্যে পরিচিত নাম। এই সীমান্তের কিছু এলাকা একেবারে বাংলাদেশের গ্রাম লাগোয়া। এমনকী সেই গ্রামে পৌঁছাতে গেলে পদ্মা পারেরও ঝুঁকি নেই। তাছাড়া চার কিলোমিটার বাদ দিলে প্রায় গোটা সীমান্তে কোনও কাঁটাতার নেই। বিএসএফ কর্তাদের দাবি, একে ঘোর বর্ষা। তার উপরে রয়েছে বিঘের পরে বিঘে পাটখেত। ফলে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য এখন চরমে। এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কড়া নজরদারি চালিয়ে সম্প্রতি এই সীমান্ত এলাকা থেকে বেশ কিছু গরু, মোষ ও কাশির সিরাপ উদ্ধার করা গিয়েছে বলে ওই বিএসএফ কর্তার দাবি।
বিএসএফের ক্ষোভ, বর্ষায় এই পাটগাছই যত নষ্টের মূলে। বহুবার প্রশাসনের কাছে বিএসএফ পাট নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। বিএসএফের ১৩০ ব্যাটেলিয়নের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘আমরা চাষিদের কোনও ক্ষতি চাই না। কিন্তু সীমান্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার বিষয়টিও। পাটের পরিবর্তে সীমান্ত এলাকায় বিকল্প কোনও চাষে প্রশাসন যদি চাষিদের উৎসাহিত করত তাহলে পাচারে অনেকটাই রাশ টানা যেত।’’ বিএসএফের অভিযোগ, প্রশাসন পাচার রুখতে কোনওভাবেই তাদের সাহায্য করছে না। তাদের প্রশ্ন, ‘‘পুলিশ সক্রিয় হলে এত রাস্তা পেরিয়ে একেবারে সীমান্তে এই গরু-মোষগুলি আসছে কী করে? পুলিশের একটা অংশের মদত ছাড়া এটা কি সম্ভব?’’
যদিও এমন অভিযোগ উড়িয়ে জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘ওই একই প্রশ্ন তো আমরাও করতে পারি। বিএসএফের একটা অংশ মদত না দিলে কী ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে হাজার হাজার গরু যাচ্ছে বাংলাদেশে?’’ ডোমকলের এসডিপিও অমরনাথ কে বলছেন, ‘‘আমরা কড়া নজর রাখছি। তবে বর্ষার কারণে পাচারকারীরা হয়তো কিছু সুবিধা নিচ্ছে। সীমান্তের থানাগুলোকেও বলা হয়েছে টহলদারি বাড়াতে।’’
তবে সীমান্তের বাসিন্দাদের দাবি, বিএসএফ ও পুলিশের সেই ‘কড়া’ নজরদারি এড়িয়েই পাচার কিন্তু চলছে। সাতসকালেই মাঠে গিয়ে দেখা যায়, জমির উপর সার দিয়ে শুয়ে রয়েছে সারি সারি পাট গাছ। নরম মাটির উপরে গরু কিংবা মোষের স্পষ্ট পায়ের ছাপ। কখনও ইতিউতি পড়ে থাকতে দেখা যায় দু’একটি কাশির সিরাপও। তাড়াহুড়োয় নিয়ে যেতে গিয়ে যেগুলি পড়ে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, এ পারে পাচারের উপর কড়াকড়ি শুরু হলে চাহিদা বাড়ে ওপারে। বাড়ে জিনিসের দামও। আরও বেশি টাকার লোভে ফের বদলে যায় পাচারের ছক। সীমান্তের রাঙাচোখ উপেক্ষা করে পাচার কিন্তু চলতেই থাকে।