চার পাতার আমন্ত্রণপত্রে রাজ্যের দুই মন্ত্রী-সহ শাসকদলের পাঁচ নেতার নাম ছিল।
গোল বেধেছিল নিমন্ত্রণপত্রের পাতা ওল্টাতেই—‘উদ্বোধক’ তথাগত রায়, রাজ্যপাল ত্রিপুরা। তৃতীয় পাতায় ‘উপস্থিত থাকবেন’-এর তালিকায় আরও দুটি নাম, ‘রাজ্য বিজেপি সভাপতি’ রাহুল সিংহ এবং ‘অভিনেত্রী’ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।
আমন্ত্রণপত্রে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের নাম দেখেই মাহেশের রথের অনুষ্ঠান বয়কট করে বসেছে তৃণমূল।
বিরোধীদের কটাক্ষ নয়, শনিবার রথযাত্রার ওই অনুষ্ঠানে অন্যতম আমন্ত্রিত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় কোনও রাখঢাক না রেখেই বলছেন, ‘‘ওখানে ধর্মে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। আমরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে পারব না। তাই যাইনি।’’
সদ্য ত্রিপুরার রাজ্যপাল হয়েছেন তথাগতবাবু। তাঁর, রাজ্য বিজেপি-র প্রাক্তন সভাপতির পরিচয়টাও অজানা নয়। তবে তৃণমূলের অন্দরের খবর, তা নিয়ে বিশেষ আপত্তি ছিল না দলের। তাঁদের আপত্তির সূত্রপাত আমন্ত্রিতদের তালিকায় রাহুল-রূপার সংযোজন। যা দেখে শাসক দলের সৌজন্য নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বিরোধীরা।
এ দিন বিকেল সওয়া চারটে নাগাদ মাহেশের রথের রশিতে টান পড়ে। তবে সেখানে তৃণমূলের বড়-মেজো কোনও নেতাকেই দেখা যায়নি। মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম প্রধান এক সেবাইত তৃণমূলের কাউন্সিলরও গরহাজির রইলেন।
শ্রীরামপুরের তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায় এ দিন মাহেশে গিয়েছিলেন ঠিকই। তবে নিয়মরক্ষা করতে। বেলা এগারোটা নাগাদ মন্দিরে প্রণাম করে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় ইদের নিমন্ত্রণ থাকায় মাহেশের রথের টানের সময় থাকতে পারিনি।’’ তবে, দলীয় অবস্থান নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। আমন্ত্রিত আর এক মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘রথযাত্রা কমিটি এক মঞ্চে যদি সব দলের লোককে রেখে রথযাত্রার সূচনা করতেন, তা হলে অন্য ব্যাপার হতো। তা হয়নি। তাই যাইনি।’’ কেন হঠাৎ বেঁকে বসল তৃণমূল? দলীয় সূত্রে খবর, ওই আমন্ত্রণপত্রের কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয় শুক্রবার রাতে। শনিবার সকালে এ নিয়ে জেলা নেতৃত্বের কাছে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘এর পরে দলের আর কেউ ও পথে পা বাড়ায়!’’জেলা নেতাদের কাছেও দলের অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।
মাহেশের রথযাত্রা আয়োজক ‘শ্রীশ্রীজগন্নাথ জিউ ট্রাস্টি বোর্ড’ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারে আমন্ত্রিতদের তালিকায় ‘বিশেষ সম্মানীয় অতিথি’ হিসেবে রয়েছে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নাম, ‘বিশিষ্ট অতিথি’ হিসেবে ছিল স্থানীয় পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় এবং স্থানীয় সাংসদ ও বিধায়কেরও নাম। তাঁরা সকলেই শাসক দলের। তবে, রূপা-রাহুলের নাম থাকায় এত আপত্তি?
ওই ট্রাস্টি বোর্ডের এক কর্তা দাবি করেছেন, ‘‘কাউকে হেয় করার জন্য কিছু করা হয়নি। প্রত্যেককে যথাযথ মর্যাদা দিয়েই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুই মন্ত্রী শুক্রবারও আসবেন বলেছিলেন। কেন কেউ এলেন না বলতে পারব না।’’
বিরোধীরা অবশ্য এর মধ্যে নতুন কিছু দেখছেন না। তাঁদের দাবি, সরকারি অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানোর সৌজন্যের বহু দিনই ধার ধারে না শাসক দল। সম্প্রতি চুঁচুড়ায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভায় জেলা পরিষদের সিপিএম সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ডানকুনিতে রেলের উড়ালপুল উদ্বোধনের সময়েও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি তৎকালীন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীকে। অথচ, সিপিএমের দাবি, ১৯৯১ সালে শ্রীরামপুরে উড়ালপুল উদ্বোধনের সময়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মঞ্চ থেকে ডেকে নিয়েছিলেন কংগ্রেসের স্থানীয় পুরপ্রধানকে।
বামেদের দাবি, রাজ্যে পালাবদলের পরেই দলের এক মন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে ‘সংস্রব’ না রাখার কথা ঘোষণা করেছিলেন। সরাসরি সিপিএমের নেতা-কর্মীদের ‘বিষাক্ত সাপের’ সঙ্গে তুলনা করে তাঁদের উপযুক্ত ‘শাস্তি’ দেওয়ার ফরমান জারি করতেও দ্বিধা করেননি।
এ দিন, মগরাহাটে দলীয় কর্মসূচি থাকায় মাহেশে আসেননি রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল। এবং বিজেপি নেত্রী রূপা। তৃণমূলের রথযাত্রা বয়কটের কথা শুনে অবাক হয়ে তিনি বলছেন, ‘‘মিলনের উৎসবে রাজনীতি? আসলে ওরা ভয় পাচ্ছে।’’