পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর গ্রামবাসীর।
ছ’মাস হল তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন তুফানগঞ্জ থানার। এর মধ্যেই তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক মহল। কখনও বিজেপির তো কখনও তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল দেখেও তিনি দেখেননি বলে অভিযোগ। এক বার তো তুফানগঞ্জ থানার সামনেই দু’গোষ্ঠীর মধ্যে মারপিট হয়েছে। থানার সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ বলছেন, এ তো কোন ছাড়। থানায় জঙ্গিদের নাম করে হুমকি ফোন এসেছে, অথচ সেই রহস্যের কিনারা হয়নি এখনও!
তিনি মহিম অধিকারী। শনিবার রাত পর্যন্ত তুফানগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন। রবিবার তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় দেওচড়াইয়ের সন্তোষপুরে গুলি চালানোর জেরে।
পুলিশের এক কর্তা জানান, ঠান্ডা মাথায় কাজ করার ধৈর্য না থাকা নিয়ে ওই ওসির বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল। কিন্তু তা বলে একেবারে তাঁর উপস্থিতিতে এমন গুলি চলবে, এতটা ভাবা যায়নি। রাতের ওই অনুষ্ঠানে গুলি না চালিয়ে অন্য ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে পুলিশ উদ্যোক্তাদের নামে মামলা বা আইনি ব্যবস্থা নিলেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এক জন ওসির উপস্থিতিতে গুলি চালানো ভাল চোখে দেখছেন না কর্তারা।
ক্লোজ হলেন ওসি মহিম অধিকারী।
পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালে মহিমবাবু পুলিশে যোগ দিয়েছেন। ২০১৫ সালের জুন মাসে তুফানগঞ্জের ওসির দায়িত্ব নেন তিনি। তার আগে কোচবিহারের ট্রাফিক গার্ডের ওসি ছিলেন তিনি। বিরাট সাফল্য কখনওই ছিল না তাঁর কেরিয়ারে। তা হলে কেন তাঁকে অসম লাগোয়া গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকার ওসি-র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছে পুলিশের একটি মহল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার দেওচড়াইয়ের সন্তোষপুরে আলোচনা অনুষ্ঠান চলার সময় হঠাৎই বিরাট সেই ঘেরাটোপের মধ্যে ঢুকে পড়ে উর্দিধারী পুলিশের বিরাট বাহিনী। অভিযোগ, মূহূর্তের মধ্যে শুরু হয় বেপোরোয়া লাঠিচার্জ। ভিড়ে ঠাসা জলসায় থাকা মহিলা, শিশুরা তো বটেই, আতঙ্কে দৌড়দৌড়ি শুরু করেন। তখনই গুলি চলে এবং পাঁচ জন জখম হন বলে অভিযোগ। জখমদের দু’জনকে ২৫ হাজার টাকা করে ও এক জনকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথাও প্রাথমিক ভাবে ঘোষণা করা হয়। তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “৫ জন গুলিতে জখম হয়েছেন। অপেক্ষাকৃত বেশি জখমদের মধ্যে ৩ জনের জন্য আর্থিক সাহায্য ঘোষণা হয়েছে। বাকিদের বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’ তিনিও ওসির শাস্তির দাবি তুলেছেন।
কোচবিহারের পুলিশ সুপার সুনীল যাদব অবশ্য বলেন, “ওসির ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।”
এর মধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছে কোচবিহার জেলা পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, কোচবিহারের এক জন ডিএসপিকে ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তের রিপোর্ট দেখে এই নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার সুনীল যাদব বলেন, “কে কোন অবস্থায় গুলি চালান তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখনই ওই ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে কিছু বলা যাবেনা।”
কে চালালেন ওই গুলি? গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছিল? পুলিশের এক কর্তার দাবি, কালীপুজোর রাতে কোচবিহার কোতোয়ালি থানার পানিশালায় জুয়ার আসরে হানা দিতে গিয়ে হামলার মুখে পড়ে পুলিশ। পরে এক সাব ইন্সপেক্টরের মৃত্যু হয়। সেই কথা মাথায় থাকায় দেওচড়াইয়ে পুলিশ ‘অতি-সক্রিয়’ হয়ে পড়ে কি না, তাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছে পুলিশ মহলের একাংশ। অন্য একটি অংশের অবশ্য বক্তব্য, গাড়ি ভাঙচুরের পর রাস্তায় ফেলে এক কমব্যাট জওয়ানকে লাঠিপেটা করা হয়। অন্য পুলিশকর্মীদের ওপর বৃষ্টির মতো ঢিল পড়তে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে প্রথমে শূন্যে গুলি চালানো হয়। তাতেও কাজ না হওয়ায় মাটি লক্ষ করে গুলি চালানো হয়। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, যিনি গুলি চালান সেই কমব্যাট জওয়ানও তুফানগঞ্জ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ওই পুলিশ কর্মীকে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জখমদের মধ্যে বেশ কয়েক জন দোকানিও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জন, আব্দুল মান্নান বলেন, “আরবি বই বিক্রির দোকান করেছিলাম। জলসার সামনে রাস্তার দোকান থেকে টেনে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বাঁ পা লক্ষ করে গুলি চালানো হয়েছে।” তাঁর মা করিবন বিবি বলেন, “নিজেদের গ্রামে দোকান করতে গিয়ে ছেলের এমন বিপদ হবে, ভাবতে পারিনি।” ঘটনার বিররণ দিতে গিয়ে মহিলারাও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হন।
কয়েক জন মহিলা জানিয়েছেন, হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। বরাত জোরে বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কা থেকে তাঁরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। এত কিছুর কেন্দ্রে যিনি, সেই ওসি কিন্তু মুখ খুলতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, যা বলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেই বলব।