অভিযুক্ত সুমন সরকার, উত্তম শিকারি, রতন সমাদ্দার ও তাপস বিশ্বাসকে বারাসত আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
প্রতিবাদীদের ভিড়েই মিশে গিয়েছিল ওরা। সবার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিল বিক্ষোভে।
অমল বাড়ুই ও ভুবন সাহা। মঙ্গলবার সৌরভ খুনে এই দুই যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশই জানাচ্ছে, সৌরভকে খুন করার পরে বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে, খেয়েদেয়ে, জামাকাপড় পাল্টে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল এরা। পরের দিন খুব ভোরে পাড়ার পরিস্থিতি জরিপ করতে ফের চলে গিয়েছিল রেললাইনের ধারে। তত ক্ষণে সেখানে জড়ো হয়ে গিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। বছর বাইশের একটি ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে কান্নাকাটি করছেন সকলে।
কেবল পরিস্থিতির উপরে নজর রাখাই নয়। ক্ষুব্ধ জনতা যখন ঘটনার প্রতিবাদে রেল ও পথ অবরোধ করেছিলেন, সেই ভিড়েও সামিল হয়েছিল ভুবন ও অমল ওরফে পুঁচে। শেষরক্ষা অবশ্য হয়নি। মঙ্গলবার ওরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “খুনের পরে শ্যামল-উত্তম-সুমনেরা গাড়ি চেপে পালিয়ে গেলেও শ্যামলের নির্দেশেই কুলবেড়িয়ায় নিজের বাড়িতে থেকে যায় ভুবন ও পুঁচে। তারা সেখান থেকেই গ্রেফতার হয়েছে।”
সৌরভ খুনের পরে এলাকার বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তদন্তকারী অফিসারেরা। কিন্তু পুঁচে ও ভুবনের নামে প্রথমে তেমন কোনও অভিযোগ মেলেনি। পুলিশের খাতায় তো নয়ই, বামনগাছির মানুষও ওই দু’জনের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেন না। স্থানীয় একটি ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি তারা যে শ্যামলের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ও নানা রকম অসামাজিক কাজকর্মে হাত পাকিয়েছিল, সে কথা কার্যত অজানাই ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে। সেই সুযোগটাই নিয়েছিল শ্যামল। খুনের পরে নিজে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলেও পুঁচে ও ভুবনকে পাড়ায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সে। যাতে এলাকার পরিস্থিতি ও পুলিশের গতিবিধির উপরে নজরদারি করে সেই খবর তার কাছে পৌঁছে দিতে পারে ওই দু’জন।
পুলিশ বলছে, শ্যামলের দলে জনা তিরিশেক ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক জনকে সব সময় নিজের কাছে রাখত শ্যামল। তারা ছিল মূলত ‘অ্যাকশন স্কোয়াড’-এর সদস্য। এলাকা দখল করতে বোমা-গুলি চালানোর দরকার পড়লে প্রথম সারিতে থাকত তারা। শ্যামলের নির্দেশে ওই ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করত উত্তম শিকারি। উত্তমকে শ্যামল খুবই বিশ্বাস করত। কারণ, বছর দুয়েক আগে সমরেশ ব্রহ্ম নামে এক দুষ্কৃতী খুন হয়। অভিযোগ, সেই খুনে শ্যামলের পাশে থেকে উত্তম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
পুলিশ সূত্রের খবর, সমরেশ এক সময় শ্যামলের ‘বস’ ছিল। তার পরে তাকে খুন করে বামনগাছির ‘দাদা’ হয়ে ওঠে শ্যামল। তার ডান হাত উত্তম এখন পুলিশ হেফাজতে। জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, দীর্ঘ দিন অসামাজিক কাজকর্মে জড়িত থাকার সুবাদে উত্তম ধীরে ধীরে ‘পেশাদার’ খুনি হয়ে উঠেছিল। ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছে, উত্তমই সৌরভের গলায় গেঞ্জির ফাঁস জড়িয়ে টেনে ধরেছিল। তাতেই লড়াই করার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছিল সৌরভ।
শ্যামলের দলে উত্তমদের পরেই ছিল সুমন সরকারের মতো ছেলেরা। নিউ ব্যারাকপুরের সাজিরহাটের বাসিন্দা সুমনের সঙ্গে শ্যামলের আলাপ হয়েছিল দমদম জেলে। পুলিশ জেনেছে, শ্যামল ছিল সুমনদের ‘নিরাপদ আশ্রয়’। কোথাও কোনও অপরাধ করে শ্যামলের ডেরাতেই গা ঢাকা দিত তারা। বামনগাছি রেললাইনের পাশে গা ছমছমে আমবাগান সন্ধের পরে হয়ে উঠত সুমনদের মুক্তভূমি। ওই ডেরায় নিশ্চিন্তে চলত নেশার আসর। পুলিশ বলছে, ভুবন বা পুঁচের মতো ছেলেরা প্রকাশ্যে শ্যামলের দলের সঙ্গে মিশত না। কিন্তু প্রতি রাতেই আমবাগানে মদের আসরে হাজিরা ছিল তাদের। শ্যামলের দলে তেমন ভাবে মিশত না বলেই সৌরভ খুনে ওই দু’জনের ভূমিকা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাননি স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্য ধৃতদের জেরা করেই ভুবনদের খোঁজ পায় পুলিশ।
ভুবন ও পুঁচেকে বুধবার আদালতে তোলা হবে। এ দিন ধৃত অন্য পাঁচ জনকে বারাসত আদালতে হাজির করে পুলিশ। বিচারক তাদের ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। অভিযুক্তদের নিয়ে আসার আগে থেকেই অবশ্য আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। পরে বামনগাছির বহু মানুষ ম্যাটডরে চেপে আদালতে এসে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের মধ্যে মহিলারাই ছিলেন বেশি। সৌরভ খুনের প্রতিবাদে এসইউসি-র দু’টি গণ সংগঠন কলেজ স্কোয়ারে ধিক্কার সভা করে।
এক দিকে যখন এই বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছে, তখন মঙ্গলবার সকালে সৌরভের পারলৌকিক কাজে বসেন তাঁর দাদা সন্দীপ চৌধুরী। বেলার দিকে ওই বাড়িতে যান দত্তপুকুর থানার আইসি সঞ্জয় চক্রবর্তী। সৌরভের বাবা সরোজ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে সব রকম পুলিশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। শ্যামল-সহ খুনের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সবাইকে গ্রেফতারের দাবি জানান সন্দীপ। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “শ্যামলের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলছে। শীঘ্রই বাকি অপরাধীরা ধরা পড়ে যাবে।”