সারদায় জড়িয়ে সরলেন আমলা

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নাক গলানোয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল অনিল গোস্বামীকে। অভিযোগ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের গ্রেফতারি রুখতে সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের ফোন করে চাপ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছে আজ সিবিআই অফিসারদের ফোন করার কথা স্বীকারও করেছেন অনিল। রাজনাথ প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তলব করা হয় অনিল গোস্বামীকে। তার পরেই তাঁকে সরে যেতে বলা হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪২
Share:

অনিল গোস্বামী

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নাক গলানোয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল অনিল গোস্বামীকে। অভিযোগ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের গ্রেফতারি রুখতে সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের ফোন করে চাপ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

Advertisement

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছে আজ সিবিআই অফিসারদের ফোন করার কথা স্বীকারও করেছেন অনিল। রাজনাথ প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা জানানোর পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তলব করা হয় অনিল গোস্বামীকে। তার পরেই তাঁকে সরে যেতে বলা হয়। আর কোনও উপায় না থাকায় পদত্যাগ করেন বিগত ইউপিএ জমানায় নিযুক্ত হওয়া এই আমলা। সিবিআইয়ের তরফে গোটা বিষয়টি আগেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সারদা কেলেঙ্কারিকে অন্যতম হাতিয়ার করছে বিজেপি। সেই সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে কেন্দ্রের কোনও আমলার নাম জড়িয়ে যাওয়ার পরেও তাঁকে পদে রেখে দেওয়ার ঝুঁকি যে মোদী সরকার নেবে না, গত কালই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গত কাল রাজনাথ তাঁর অফিসারদের থেকে বিষয়টি জানতে পেরে মন্তব্য করেছিলেন, দুর্নীতিতে নাম জড়ালে কাউকেই আড়াল করা হবে না। দিল্লির ভোটের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশাসনিক দৃঢ়তার পরিচয় দেওয়ায় ভোটযন্ত্রেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছেন বিজেপির নেতারা।

Advertisement

অনেক দিন ধরেই বিজেপির বিরুদ্ধে সিবিআইকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এই প্রশ্নে তাঁরা সংসদ অচল করেছে বারবার। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিবিআইয়ের ইপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলে সারদা-তদন্তে শীর্ষ আদালতের নজরদারি চেয়ে আবেদনও করেছে সুপ্রিম কোর্টে। কংগ্রেসের কপিল সিব্বল তাদের হয়ে মামলা লড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিজেপি ও বাম নেতারা অভিযোগ তুলেছিলেন, কংগ্রেসের নেতা জালে জড়াচ্ছেন বুঝেই তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে ময়দানে নেমেছেন।

মোদী সরকার তথা বিজেপি বরাবরই বলে এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআই তদন্তে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না। সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থেও কাজে লাগানো হবে না। আজ কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষস্থানীয় আমলাকে সরিয়ে দিয়ে মোদী সরকার সেই বার্তাই দিয়েছে। অনেকের মতে, সুপ্রিম কোর্টে সারদা-তদন্তে শীর্ষ আদালতের নজরদারির আবেদন নিয়ে শুনানির আগেই মোদী সরকার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে চাইল, তাদের আমলে সিবিআই মোটেই আর ‘খাঁচার তোতাপাখি’ নয়। বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় ও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আজ দাবি করেছেন, সিবিআই যে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবে তদন্ত করছে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপই তার প্রমাণ।

তৃণমূলের অন্দরে অবশ্য বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে। তাদের মতে, মোদী ও রাজনাথের মধ্যে বনিবনার সমস্যা ছিলই। সরকারের দুই মাথার দ্বন্দ্বের জেরেই বলির পাঁঠা করা হল অনিল গোস্বামীকে।

গত শনিবার কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআইয়ের দফতরে হাজির হয়েছিলেন মাতঙ্গ সিংহ। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তির বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়। এর পরেই অভিযোগ ওঠে, মাতঙ্গের গ্রেফতারি রোখার চেষ্টা করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। গত কাল রাজনাথ বিষয়টি জানতে পারেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রসচিব তখন দিল্লিতে ছিলেন না। আজ সকালে দিল্লি ফিরে তিনি নর্থ ব্লকে নিজের দফতরে ফিরে আসার পরেই রাজনাথ তাঁকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। তাঁর কাছে গোটা বিষয়টির ব্যাখ্যা চান। সূত্রের খবর, প্রথমে স্বরাষ্ট্রসচিব যুক্তি দিয়েছিলেন মাতঙ্গ তাঁকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু পরে নিজেই স্বীকার করেন যে, তিনি সিবিআই অফিসারদের ফোন করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, রাজনাথ তখনই অনিলকে জানিয়ে দেন যে, তাঁর আর স্বরাষ্ট্রসচিব পদে থাকা হবে না।

স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে এক ঘণ্টা কথা বলার পরেই রাজনাথ বৈঠক করেন সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অনিল সিন্হার সঙ্গে। তাঁর কাছে জানতে চান, ঠিক কী হয়েছিল। আধ ঘণ্টা চলে ওই বৈঠক। সিন্হা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, মাতঙ্গ কলকাতায় সিবিআই দফতরে হাজির হওয়ার পর থেকেই তাঁর উপরমহলে যোগাযোগের কথা বলতে শুরু করেন। বেশ কয়েক জনকে ফোনও করেন তিনি। তাঁকে গ্রেফতার করা হলে ফল ভাল হবে না বলে হুমকিও দেন। তার পরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ফোন আসে। তদন্তকারী অফিসারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়। গ্রেফতারি রোখার চেষ্টা হয়। মাতঙ্গকে কেন ডাকা হয়েছে, তোলা হয় সেই প্রশ্নও। মাতঙ্গের বিষয়টা যেন ‘একটু দেখা’ হয়, সেই পরামর্শও দেওয়া হয় দিল্লি থেকে। রাজনাথ এর পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। বিকেলে স্বরাষ্ট্রসচিবকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তলব করা হয়। তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব পদ থেকে অনিলকে সরতে হবে। গোটা বিষয়টি নিয়ে অনিল গোস্বামী নিজে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। রোজকার মতোই সন্ধে পর্যন্ত দফতরে থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

অনিল গোস্বামীর আগে জম্মু-কাশ্মীর ক্যাডারের আর কোনওআইএএস অফিসার সরকারের শীর্ষ পদে বসেননি। আগামী জুন মাসে তাঁর অবসর নেওয়ার কথা ছিল। অনিলের জায়গায় নতুন স্বরাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন সচিব এল সি গয়ালকে। মন্ত্রিসভার নিযোগ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে মোদী-রাজনাথরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এল সি গয়াল এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক যুগ্মসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। কেন্দ্রে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শিবরাজ পাটিল।

সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, নরসিংহ রাও সরকারের মন্ত্রী মাতঙ্গের বিরুদ্ধে তদন্তে করতে গিয়ে এর আগেও তদন্তকারীদের চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। কানাড়া ব্যাঙ্ক থেকে ৬৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে একটি চ্যানেল খুলেছিলেন মাতঙ্গ। কিন্তু সেই ঋণ শোধ করেননি। ২০১৩-তে ওই মামলায় মাতঙ্গের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। সেই চার্জশিট যাতে পেশ না হয়, সে বিষয়ে সিবিআইয়ের উপর চাপ তৈরি করা হয়েছিল। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের থেকে তিনি ব্যবসায়িক চুক্তি বাবদ ২৮ কোটি টাকা নিয়েছিলেন। চুক্তি বাতিল হলেও টাকা ফেরত দেননি বলে অভিযোগ। ইদানীং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভাবে সক্রিয় না থাকলেও মাতঙ্গ তাঁর প্রভাব ও যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অসম ক্যাডারের অফিসারদের নিয়োগ ও বদলির বদলির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন