শবাধারের ভিতরে রেখেছেন কবরের টাকাও

নিজের কবরটা শুধু নিজে খুঁড়ে যাননি! কলকাতা থেকে পুরুলিয়া পর্যন্ত শেষ যাত্রার পথে শনিবার আগে আগে থাকল প্রবীণ বাম নেতা অশোক ঘোষের ছবি সংবলিত একটি মিনি ভ্যান। তাতে বসানো সাত ফুট বাই তিন ফুটের একটা কাঠের বাক্স।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০৩:০৪
Share:

বিদায়। শনিবার কলকাতায় ফব-র দফতরে প্রয়াত বাম নেতা অশোক ঘোষকে কুর্নিশ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

নিজের কবরটা শুধু নিজে খুঁড়ে যাননি!

Advertisement

কলকাতা থেকে পুরুলিয়া পর্যন্ত শেষ যাত্রার পথে শনিবার আগে আগে থাকল প্রবীণ বাম নেতা অশোক ঘোষের ছবি সংবলিত একটি মিনি ভ্যান। তাতে বসানো সাত ফুট বাই তিন ফুটের একটা কাঠের বাক্স। চকচকে নয় একেবারেই! বেশ পুরনো। পিছনে শববাহী শকটে অশোকবাবু। ওই কাঠের বাক্স আসলে যাঁর শেষ আধার হবে!

প্রবীণতম বাম নেতাকে চির বিদায় জানাতে আয়োজনের কোনও ক্রটি রাখেনি ফরওয়ার্ড ব্লক এবং বামফ্রন্ট। কিন্তু এই শব-বাক্স (ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাসকেট। ভ্যাম্পায়ারের সিনেমায় দেখা মাথা চওড়া, পায়ের দিকে সরু কফিন নয়) তাদের জোগাড় করতে হয়নি। ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন স্বয়ং অশোকবাবু! কাঠের মিস্ত্রীকে বরাত দিয়ে বাক্স তৈরি করিয়ে দলের রাজ্য দফতরে রাখা ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। ছিল একটি চিঠিও। যেখানে ব্যাখ্যা করা আছে, হিন্দু ঘরের সন্তান হয়েও দেহান্তে তাঁর এই মাটিতে মিশে যাওয়ার আর্জির কথা। এবং তাতেও শেষ নয়! ওই কাঠের বাক্সের ডালা খুলে ফব নেতারা আবিষ্কার করেছেন কিছু টাকা। যা কাজে লাগাতে হবে অশোকবাবুর দেহ সমাহিত করার পরে প্রথা মেনে শেষকৃত্যের খরচ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। আগাম এমন ব্যবস্থাপনার কথা অশোকবাবুর মৃত্যুর পরে জানতে পেরেছেন ফব নেতারা এবং জেনে কপালে হাত ঠেকাচ্ছেন!

Advertisement

শেষকৃত্যের আগে শেষ পর্বটা অবশ্য একেবারে টানাপড়েন-মুক্ত যায়নি ফব-র অন্দরে। অশোকবাবুকে খামোখা পুরুলিয়া টেনে নিয়ে গিয়ে সমাহিত না করে নিমতলা মহাশ্মশানে সৎকার করানোর জন্য দাবি তুলেছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য। এর আগে হেমন্ত বসু, নলিনী গুহ বা চিত্ত বসু— ফব-র কোনও নেতাকেই প্রয়াণের পরে সমাহিত করা হয়নি। ওই দুই নেতার দাবি ছিল, অশোকবাবুর শেষ ইচ্ছার নামে নির্ঘাত কিছু ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে! শেষ পর্যন্ত বাক্স এবং টাকা আবিষ্কার টানাপড়েনে ইতি টানতে সহায়ক হয়েছে। শেষে ফব নেতারাও বলার সুযোগ পেয়েছেন, মৃত্যুতেও দুই ধর্মকে মিলিয়ে দেওয়ার অনন্য নজির রেখে গেলেন তাঁদের রেকর্ড সময়ের রাজ্য সম্পাদক।

পুরুলিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে যাওয়ার আগে অশোকবাবুকে নিয়ে শোকমিছিল এ দিন হেমন্ত বসু ভবন থেকে শুরু হয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তিতে শেষ হয়। সেখানেই সাময়িক বিরতির সময়ে ফব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস বলছিলেন, ‘‘বাক্সের মধ্যে কত টাকা আছে, সেটা আমরা পুরুলিয়ায় শেষ কাজের আগে গুনে দেখব ঠিক করেছি। অশোকদা কী কী কাজ যে করে রেখে যেতে পারেন, এত দিনেও সবটা ধারণা আমাদের ছিল না দেখলাম!’’

শববাহী শকটে বসে চোখের জলে গাল ভিজে যাচ্ছিল কানাই শী-র। অশোকবাবুর আশ্রয়েই ফব-র রাজ্য দফতরে থাকতেন, তাঁকে ‘বাবু’ বলে ডাকতেন। আদতে পিংলার বাসিন্দা কানাইবাবুর কথায়, ‘‘বাবুর কাছে আছি ১৯৬৯ সাল থেকে। সব দিকে নজর ছিল ওঁর। সব গুছিয়ে রাখা চাই! এমন মানুষ আর হবে না।’’ গাড়ির মধ্যে বসেই সম্মতির ঘাড় নাড়েন জগন্নাথ পাত্র। অশোকবাবুর সর্বক্ষণের আর এক সঙ্গী। দলীয় দফতর তথা নিবাস থেকে শেষ বার অশোকবাবুকে বার করার সময় মরদেহে কাঁধ দিতে ডেকে নেওয়া হয়েছিল এই দু’জনকেই।

ব্যবস্থা যা হয়েছে, পুরুলিয়ার ফব দফতরে রাতে থাকছে মরদেহ। সেখান থেকে সুইসার আশ্রমে নিয়ে গিয়ে আজ, রবিবার সকালে মরদেহ ভরা হবে ওই কাঠের বাক্সে। প্রথা মেনে সেই সময়েই গান স্যালুট দেবে পুলিশ বাহিনী। শেষ লগ্নের মিছিলে থাকার কথা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর। আর আগে এ দিন কলকাতায় ফব দফতরে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। খাতায় লিখে কুর্নিশ জানিয়েছেন ‘অশোকদার অম্লান স্মৃতি’র উদ্দেশে। এসেছেন কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিজেপির শমীক ভট্টাচার্যও। শ্যামবাজার পর্যন্ত মিছিলে হেঁটেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, দেবব্রতবাবু, মনোজ ভট্টাচার্য, নরেন চট্টোপাধ্যায়েরা। ফব-র ৯৪টি অর্ধনমিত পতাকার সঙ্গে মিছিলে থেকেছে সিপিএমের ৯৪টি পতাকাও। অশোকবাবুর জন্যই যে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল সিপিএম।

অশোকবাবুর নিজস্ব ব্যবস্থা অবশ্য আরও আগে প্রস্তুত ছিল। জায়গা বাছা ছিল, বাক্স ছিল, টাকা ছিল। আর একটু সুযোগ পেলে নিজের কবর নিজে খোঁড়ার প্রবাদও কি সত্যি করে যেতেন না তাঁদের অভিভাবক, ভাবছেন দলেরই কেউ কেউ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন