হাসি মুখে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনিল ভুঁইমালি (একেবারে ডান দিকে)। একেবারে বাঁয়ে, প্রেসিডেন্সির অনুরাধা লোহিয়াও। শুক্রবার শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে। ছবি: সুদীপ আচার্য।
এর আগে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে আচার্যকে এড়িয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রীকে। কেউ আবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে হাজির থেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তৈরি করেছেন বিতর্ক। কিন্তু শুক্রবার এ সবই পিছনে পড়ে গেল।
গেল, কারণ এ দিন রাজ্য সরকারের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে যা হল, তা এক কথায় নজিরবিহীন। বস্তুত সেখানে উপস্থিত উপাচার্যদের কেউ কেউ যে ভাবে সরকারকে ঢালাও সার্টিফিকেট দিলেন, এবং মুখ্যমন্ত্রী-বন্দনায় একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার বিসর্জনের বিষয়টি ফের ভীষণ রকম প্রকট হয়ে উঠল।
কী রকম?
রাজ্যের ‘সাফল্য’ প্রসঙ্গে সরকারি বিবিধ অনুষ্ঠানে কর্তাদের তরফে ফিরিস্তি দেওয়া হয়, গত চার বছরে রাজ্যে কত নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ দিন শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরলেন এক উপাচার্যই। শিক্ষকদের ‘শিক্ষারত্ন’ দেওয়ার পরিকল্পনা যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন আর এক জন। কেউ বলতে শুরু করলেন, মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা উপকৃত হয়েছেন!
এ দিন নজরুল মঞ্চের ওই অনুষ্ঠানে বক্তা-তালিকায় উপাচার্যদের মধ্যে প্রথম নামই ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরঞ্জন দাসের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন যিনি শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর হাতে রিপোর্ট তুলে দিয়ে এসে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। এ দিন অবশ্য তিনি সরাসরি প্রশস্তির পথে যাননি। তবে পরবর্তী বক্তারা প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীকে।
যেমন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সুগত মারজিত। দায়িত্ব পেয়ে যিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে বসানোর মাধ্যমেই রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করেছে। এ দিন সুগতবাবু বলেন, ‘‘ভাল কাজের সম্মান জানালে উৎসাহ বাড়ে, আত্মশক্তি বাড়ে। এটা অনেক দিন কেউ বুঝতে পারেননি। কেউ করেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পেরেছেন।’’ সুগতবাবু এ-ও বলেন, ‘‘মানুষ যখন কোনও কাজ করে, তখন সব সময় অর্থ চায় না। চায় কাজের যশ। এটা অনেক দিন আমাদের এখানে অন্য কেউ ভাবেননি।’’
প্রশস্তির দৌড়ে আর এক ধাপ এগিয়ে যান প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা-হাব হবে, এটা মুখ্যমন্ত্রীর ও আমাদের সকলের স্বপ্ন।’’ আর তার পরেই গত তিন বছরে তৃণমূল সরকার রাজ্যে কত বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল তৈরি করেছে, তার ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন। শাসকদলের নেতা বা মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে ভাবে তাঁদের কাজের হিসেব-নিকেশ দেন, প্রায় সে ভাবে উপাচার্য বলতে থাকেন, ‘‘গত তিন বছরে ১৩টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অনেক নতুন কলেজ হয়েছে। অনেক ভাল ভাল কাজ হয়েছে।’’
প্রসঙ্গত অনুরাধাদেবী গত জুলাইয়ে বধর্মানে রাজ্য প্রশাসনের শততম বৈঠকে গিয়েও সরকারের স্তুতি করেছিলেন। সরকারি প্রতিনিধি হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনেও গিয়েছেন। তার পরে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্সিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে পড়েছেন ছাত্র বিক্ষোভের মুখে।
এ দিকে বৃহস্পতিবার যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার খবরে রাজ্য উত্তাল হয়েছে, সেই রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনিল ভুঁইমালিও এ দিন নজরুল মঞ্চে হাজির ছিলেন। ঘটনাটি সম্পর্কে বৃহস্পতিবারই তিনি রিপোর্ট দিয়েছেন। তবে রাজভবনে নয়, বিকাশ ভবনে। অনুষ্ঠানে তিনি কিছু বলার সুযোগ না-পেলেও আগাগোড়া মুখ্যমন্ত্রীর পাশে পাশেই ছিলেন। নিজের প্রতিষ্ঠানে এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি সত্ত্বেও রায়গঞ্জ ছেড়ে কলকাতায় এলেন কেন জানতে চাওয়া হলে অনিলবাবুর জবাব, ‘‘এখানে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। আমার কাছে এই অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপর্ণ।’’
তা উপাচার্যদের এ হেন সরকার স্তুতিকে ‘সরকার’ কী ভাবে দেখছে?
এক সঙ্গে ৯ জন উপাচার্যকে মঞ্চে বসতে দেখে তিনি যে আপ্লুত, মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে সেটা জানিয়েছেন। এ দিন তাঁর ঘোষণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য তিনি আগামী বছর থেকে ‘শিক্ষাভূষণ’ সম্মান চালু করবেন।
অন্য দিকে শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মতে, এ দিনের অনুষ্ঠান থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। তা হল: রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার রক্ষায় যেমন যত্নবান নয়, তেমন উপাচার্যদেরও সিংহভাগ এ বিষয়ে আগ্রহী নন। এক সদ্য প্রাক্তন উপাচার্যের কথায়, ‘‘এই স্তাবকতার সূত্রেই শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘরোয়া বিষয়ে উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট তলব করতে পারেন। বলতে পারেন, সরকার টাকা দেয়, তাই হস্তক্ষেপের অধিকার আছে!’’
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘উপাচার্যেরা তো দেখছি দলদাসে পরিণত হয়েছেন! শিক্ষায় যখন চরম অরাজকতা, গুলি-বোমা চলছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়েও ওঁরা কিছু বললেন না! অবাক কাণ্ড!’’ তাঁর উপলব্ধি, ‘‘আসলে শিক্ষার উন্নয়নের চেয়ে সরকারের গুণগানেই ওঁরা বেশি ব্যস্ত।’’ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘উপাচার্যদের উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার স্থান বজায় রাখা। সরকারের হয়ে কথা বললে সেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।’’ যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুর মন্তব্য, ‘‘এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলে ভাল হতো।’’ রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার অবশ্য মনে করেন, এমন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে যাওয়া উচিত। ‘‘তবে সেখানে সরকারের গুণগান না-করে শুধু শিক্ষা নিয়ে কথা বললে ভাল লাগত।’’— বলেন পবিত্রবাবু।
উল্লেখ্য, এই তিন প্রাক্তন উপাচার্যই বামফ্রন্ট আমলের। বাম জমানায় শিক্ষক দিবসে কি এ ভাবে উপাচার্যেরা যেতেন?
শিক্ষা দফতরের এক আমলা জানাচ্ছেন, তখন মূলত স্কুলশিক্ষা দফতর শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান করত। তাই সেখানে উপাচার্যদের ডাকার প্রশ্ন ছিল না।’’
এ দিন যাঁরা সরকারি অনুষ্ঠানে ছিলেন, তাঁদের কী বক্তব্য? উপাচার্যদের অধিকাংশের দাবি, তাঁরা অনৈতিক কিছু করেননি, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারও লঙ্ঘিত হয়নি। সুগতবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘উচ্চশিক্ষা দফতর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাই গিয়েছি। এর সঙ্গে স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের সম্পর্ক নেই।’’ অনুরাধাদেবীর মন্তব্য, ‘শিক্ষকদের সম্মান সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছি। তাই গিয়েছিলাম। স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের প্রশ্ন ওঠে না।’’ সুরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘এটাকে সরকারি অনুষ্ঠান হিসেবে দেখছি না। এটা শিক্ষকদের সম্মানের অনুষ্ঠান। আমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছি। স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের কথা উঠছে কী করে?’’