শহরের আকাশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শকুন-হাড়গিলেরা

শকুনের মতো মৃতদেহ বা ভাগাড়ের উপরে নির্ভরশীল পাখি ছিল হাড়গিলে (গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক)। এক সময়ে শহরের বিভিন্ন ভাগাড় বা শ্মশানে তাদের আকছার দেখা যেত।

Advertisement

কৌশিক ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৯ ০০:৫৪
Share:

হারিয়ে যাচ্ছে এমনই সব পাখি। ফাইল চিত্র

পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে শকুনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বর্তমানে খাস কলকাতা ও শহরতলিতে আনুমানিক ক’টি শকুন রয়েছে, তার কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। ২০০৪-’০৫ সালে এক বার বন দফতরের উদ্যোগে শকুন গণনা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, গোটা রাজ্যে শ’তিনেক শকুন রয়েছে। বছর কয়েক আগে শকুন সংরক্ষণের বিভিন্ন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কিন্তু তাতেও শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

Advertisement

বস্তুত, শকুনের মতো মৃতদেহ বা ভাগাড়ের উপরে নির্ভরশীল পাখি ছিল হাড়গিলে (গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক)। এক সময়ে শহরের বিভিন্ন ভাগাড় বা শ্মশানে তাদের আকছার দেখা যেত। উনিশ-বিশ শতকের একাধিক বাংলা সাহিত্যে তার উল্লেখ রয়েছে। এমনকি, কলকাতা পুরসভার লোগোতেও ঠাঁই পেয়েছিল হাড়গিলেরা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাড়গিলে কলকাতা থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং রাজ্য বন দফতর সূত্রের খবর, বছর পাঁচেক আগেও ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন ময়দান, মধ্য কলকাতার নিউ মার্কেট এবং বটানিক্যাল গার্ডেনে হাতে গোনা কয়েকটি শকুনের দেখা মিলত। তারও আগে নিউ আলিপুরে রেললাইনের ধারে একটি গাছে অনেক শকুন দেখা যেত। কিন্তু ওই সমস্ত জায়গায় এখন সে ভাবে আর শকুনের দেখা মেলে না। রাজ্য বন দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, আজকাল শকুন যে একেবারেই দেখা যায় না, তা নয়। কিন্তু সংখ্যায় খুবই কম। তবে সেই সংখ্যাটা কত, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা সম্ভব নয়।

Advertisement

কেন উধাও হয়ে যাচ্ছে শকুনেরা?

পাখি বিশারদদের একাংশ বলছেন, শহরাঞ্চলে খোলা ভাগাড়ের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। তার উপরে ওই ভাগাড়ের মাংসই শকুনদের বিপদ ডেকে এনেছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বন দফতরের সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট, বহু ক্ষেত্রেই পশুদের ‘ডাইক্লোফেনাক’ গোত্রের ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয়। মৃত পশুর দেহাবশেষ থেকে সেই ওষুধ শকুনদের শরীরে ঢুকেই বিপদ বাড়িয়েছে। ওই ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় তাদের কিডনি বিকল হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বহু ক্ষেত্রে শকুনদের মৃত্যুর পিছনে সেটাই দায়ী। ‘জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-র পাখি বিভাগের প্রধান গোপীনাথন মহেশ্বরণ বলেন, ‘‘শহরে বিভিন্ন কারণেই শকুন কমতে পারে। তবে মূলত ওষুধের ব্যবহারের ফলেই এই শহরে শকুনের সংখ্যা কমছে।’’ তাঁর মতে, আশির দশকে শহরাঞ্চলে শকুনের যে সংখ্যা ছিল, তা প্রায় ৯৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। কয়েক দিন আগেই চালসায় শকুনের উপরে একটি আলোচনাচক্রেও এই তথ্য উঠে এসেছে।

গোপীনাথন জানান, কলকাতা তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের কোথাওই আর হাড়গিলের দেখা মেলে না। অসমের গুয়াহাটিতে কিছু দেখা যায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় উন্মুক্ত ভাগাড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলেই এই পাখিরা ক্রমে হারিয়ে গিয়েছে।’’

তিনি জানান, দ্রুত নগরায়ণ এবং উঁচু বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহর থেকে চিল কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি। কারণ, চিল উঁচু বহুতলের কার্নিসে বসতে পছন্দ করে। তাঁর মতে, বহুতলের কার্নিস থেকে চিলের পক্ষে নীচে থাকা শিকারে নজর রাখতে সুবিধা হয়। শহরে তারা খাবারও প্রচুর পায়।

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, নব্বইয়ের দশক থেকেই গবাদি পশুর শরীরে ‘ডাইকোফেনিক’ নামে এক ধরনের ব্যথা উপশমের ওষুধ দেওয়া শুরু হয়। পরে সেই পশুর মৃতদেহ খেয়ে শকুনের মতো পাখিরা অসুস্থ হতে শুরু করে। শুরু হয় ঝিমুনি বা ‘ড্রুপিং সিনড্রোম’। এতে গাছের ডালে বসে পাখিরা ঝিমোয়। পরে গাছ থেকে পড়ে মারা যায়। মৃত পাখিদের দেহের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এই ধরনের ওষুধ শরীরে প্রবেশ করায় তাদের মূত্রাশয় সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৮ সালে গবাদি পশুর উপরে ওই ওষুধের প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা সব সময়ে মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। গবেষকদের একাংশের মতে, শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াও পরোক্ষ ভাবে দায়ী।

জ়েডএসআই সূত্রের খবর, খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময়েই শকুনেরা পাশের রাজ্যে চলে যায়। গ্রামগঞ্জে তাদের পক্ষে খাবার জোগাড় করা সহজ হয়। প্রাণী সর্বেক্ষণের বিজ্ঞানী কৌশিক দেউটির মতে, শকুন পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখে। তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সেই ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন