এমনই হাল মুকুটমণিপুরের।— নিজস্ব চিত্র।
পিকনিক করতে এলে নিয়ম করে রাস্তা থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু মুকুটমণিপুর জলাধারে পিকনিকের আবর্জনা সরাতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। জলাশয়ের চারদিকে আবর্জনার স্তূপ দেখে এখন এমনই বিরক্তি প্রকাশ করছেন পর্যটকেরা।
মুকুটমণিপুরে এ বার তেমন জল নেই। কিন্তু পর্যটকদের আনাগোনা তাতে কমেনি। টলটল নীল জল, দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়ের উঁকিঝুঁকির আকর্ষণ এতটুকুও কমেনি। তাই বাতাসে হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করতেই পর্যটকেরা আনাগোনা শুরু করেছিলেন। পিকনিক করতে আসা মানুষজনেরও ভিড় বাড়ছিল। তাঁদের ফেলে যাওয়া থার্মোকলের থালা, প্লাস্টিকের গ্লাস, সব্জির খোসা থেকে মুরগির পালক সবই জমে থাকছে জলাধারের পাড়ে। তাতে যেমন দৃশ্য দূষণ হচ্ছে, তেমনই দুর্গন্ধেও অতিষ্ঠ পর্যটকেরা। শুধু তাই নয়, জলের কাছাকাছি এলাকায় অনেকেই খোলা আকাশের নীচেই প্রাকৃতিক কাজ সারছেন। ফলে পা এ দিক-ও দিক হলেই জুতো নোংরা হওয়ার ভয় থাকে। অনেকে আবার এখানে মদ্যপান করে ভাঙা বোতলও ফেলে রেখে যাচ্ছেন। ফলে কাচের টুকরো পায়ে বিঁধে রক্তারক্তি হওয়ারও আশঙ্কা রয়ে গিয়েছে।
এ ছবিটা কিন্তু এ বারেই বিচ্ছিন্ন নয়। বছরের পর বছর বড়দিনের ছুটিতে আসা পর্যটকদের ভিড় বাড়ার পরেই মুকুটমণিপুর জলাধার লাগোয়া এলাকায় এই দৃশ্য দেখা যায়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই রোজ বেশ কিছু দল এখানে পিকনিক করতে আসছেন। আবর্জনার পাশেই অনেককে বাধ্য হয়ে রান্নার উনুন জ্বালাতে হচ্ছে। সেখানেই বসে তাঁরা খাওয়াদাওয়া করছেন। তাই এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে পযর্টকদের অনেককেই সরব হতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। কেন? খাতড়ার বিডিও অনূসুয়া ভট্টাচার্যের দাবি, “গত কয়েক বছরে মুকুটমণিপুরে পানীয় জলের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। শৌচাগারও তৈরি করা হয়েছে। এতে অনেকটাই পরিস্থিতি বদলেছে। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা দরকার সবার আগে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মুকুটমণিপুরকে ঘিরে পর্যটনের বিকাশের কথা মাঝে মধ্যেই শোনান। তিনি নিজেও এই পর্যটনকেন্দ্রটিকে বিশেষ ভাবে পছন্দ করেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জেলা সফরে এসে কয়েকবার তিনি মুকুটমণিপুরেই থেকেছেন। প্রশাসনিক বৈঠকও করেছেন। গত বছরে মুকুটমণিপুরে মুসাফিরানা নামের একটি পার্কের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু পর্যটকদের আক্ষেপ, কিছু মানুষ এত সুন্দর এলাকাকে নোংরা করে দিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সর্তক করা যেমন দরকার, তেমনই প্রশাসনেরও রোজ আবর্জনা সাফ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ায় প্রয়োজন। তা নাহলে এই সুন্দর জায়গাটারই বদনাম হবে। এখানকার পর্যটনেও যার প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়।
ক’দিন আগেই জলাধারের পাড়ে সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দুর্গাপুরের বাসিন্দা মানিক অগ্নিহোত্রী। বিরক্তি ভরা মুখে তিনি বলেন, “এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা অনেকের মুখেই শুনেছিলাম। সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতোই জলাধার। তবে পিকনিকে আসা লোকজনের উপর প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই পরিবেশটা জঘন্য হয়ে উঠেছে।” কিছুটা দূরেই গাঁক গাঁক করে বড় বড় সাউন্ডবক্স বাজিয়ে একদল ছেলে তখন উদ্দাম নাচছিলেন। কয়েকজনের হাতে মদের বোতলও ছিল। সোনামুখী থেকে পড়শিদের নিয়ে বাস ভাড়া করে পিকনিক করতে আসা শ্যামলী নাগের কথায়, “ভদ্র লোকেদের পিকনিক করার মতো পরিস্থিতিই নেই এখানে।”
পর্যটকেরা প্রশ্ন তুলছেন, স্থানীয় গোড়াবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত রাস্তা আটকে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে ৫০ টাকা করে প্রবেশ মূল্য নিচ্ছে। অভিযোগ, যাঁরা ওই পথ ধরে অন্য কোথাও যাচ্ছেন তাঁদের কাছ থেকেও মুকুটমণিপুরের প্রবেশ মূল্য হিসেবে টাকা নেওয়া হচ্ছে। তাহলে ওই টাকা দিয়ে মুকুটমণিপুরের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে না কেন?
তা হলে ওই টাকায় কী হচ্ছে?
গোড়াবাড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান শ্রীকান্ত নাবিক জানান, গত বছর পর্যটন মরসুমে প্রবেশ মূল্য বাবদ প্রায় ৪ লক্ষ টাকা আদায় করেছিল পঞ্চায়েত। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কেন পিকনিক করার জায়গাটিকে নিয়মিত পরিষ্কার করানো হচ্ছে না? তাঁর দাবি, ‘‘৪০ জন লোককে পিকনিক স্পট পরিষ্কার করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বনভোজনে আসা লোকজনের ভিড় শুরু হয়ে যাচ্ছে জলাধারের পাড়ে। তাই সাফাই কাজ ব্যহত হচ্ছে।’’ অন্তত কয়েকটা ‘ডাস্টবিন’ রাখলেও তো সমস্যা কিছুটা এড়ানো যায়? তাঁর জবাব, ডাস্টবিন রাখা হয়েছিল। কিন্তু পিকনিক সেরে ফিরে যাওয়ার পথে সেগুলি গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন পিকনিক করতে আসা লোকজন। তাই এখন আর ডাস্টবিন রাখা হচ্ছে না। ফলে মুকুটমণিপুরের অস্বাস্থ্যকর ছবিটা কবে বদলাবে তার সদুত্তর মেলেনি।