Civic Volunteer Training

সিভিক ভলান্টিয়ারদের শেখানো হচ্ছে ‘সভ্যতা-ভব্যতা’, বাংলা জুড়ে শুরু প্রশিক্ষণ, ‘বদনাম’ ঘোচাতে নির্বাচনের আগে শিক্ষা

সমস্ত জেলার পুলিশ সুপার এবং পুলিশ কমিশনারকে সিভিক-প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বার্তা পাঠিয়েছেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (ট্রেনিং)। কোন জেলা বা কমিশনারেটের অন্তর্গত কত জন সিভিককে প্রশিক্ষণে পাঠাতে হবে, তা-ও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে ওই বার্তায়।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৫ ১০:২৮
Share:

সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিতে কোমর বেঁধে মাঠে নামল রাজ্য পুলিশ। ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।

গত দেড় দশকে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে! সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিতে কোমর বেঁধে নেমেছে রাজ্য পুলিশ। উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমাঞ্চলে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে প্রশিক্ষণ। সেখানে হাতেকলমে সিভিকদের শেখানো হচ্ছে, ‘কী করিতে হইবে’। তার চেয়েও বেশি করে শেখানো হচ্ছে, ‘কী করিতে হইবে না’।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের চারটি জায়গায় ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন পুলিশ জেলা ও কমিশনারেটের অধীনে কর্মরত সিভিক ভলান্টিয়ারদের।

নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের প্রশিক্ষণ হবে কৃষ্ণনগরের সশস্ত্র পুলিশের নবম ব্যাটেলিয়নে। পূর্ব মেদিনীপুরের সালুয়ায় তিনটি জায়গায় ভাগ করে হবে ঝাড়গ্রাম, হাওড়া গ্রামীণ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি গ্রামীণ জেলা পুলিশ, হাওড়া ও খড়্গপুর জিআরপি-র অধীনে থাকা সিভিকদের প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া বরজোড়া, আসানসোল, পুরুলিয়া, দুর্গাপুর এবং বীরভূমের রাজনগরে প্রশিক্ষণ হবে সংশ্লিষ্ট জেলা ও কমিশনারেটের সিভিক ভলান্টিয়ারদের।

Advertisement

বাদ পড়েনি উত্তরবঙ্গও। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে সশস্ত্র পুলিশের চতুর্থ ব্যাটেলিয়নে প্রশিক্ষণ হবে মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রায়গঞ্জ এবং ইসলামপুর জেলা পুলিশের সিভিকদের। জলপাইগুড়ির দ্বাদশ ব্যাটেলিয়নে প্রশিক্ষণ নেবেন জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের সিভিকেরা। শিলিগুড়ি কমিশনারেট এবং কালিম্পং জেলা পুলিশের অধীনস্থ সিভিকদের প্রশিক্ষণ হবে ডাবগ্রামে। শিলিগুড়ি স্থিত র‌্যাফের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে হবে দার্জিলিংয়ের সিভিকদের প্রশিক্ষণ।

শিলিগুড়ি স্থিত ডাবগ্রামে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পুলিশ জেলা ও কমিশনরাটের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সিভিক থেকে শুরু করে আইবি-র অধীনে থাকা সিভিকেরা সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছেন। পাঁচ দিন ধরে থেকে এই প্রশিক্ষণ নিতে হচ্ছে তাঁদের। সমস্ত জেলার পুলিশ সুপার এবং পুলিশ কমিশনারদের সিভিক-প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বার্তা পাঠিয়েছেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (ট্রেনিং)। কোন জেলা বা কমিশনারেটের অন্তর্গত কত জন সিভিককে প্রশিক্ষণে পাঠাতে হবে, তা-ও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে ওই বার্তায়। সব মিলিয়ে এই পর্বে আট হাজারের বেশি সিভিকের প্রশিক্ষণ হবে উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে। আপাতত এই প্রশিক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে কলকাতা পুলিশের অধীনস্থ সিভিকদের। শুধুমাত্র পুরুষ সিভিকদেরই এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখনও মহিলা সিভিকদের বিষয়ে কোনও নির্দেশিকা পাঠায়নি ভবানী ভবন।

কী শেখানো হচ্ছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের?

প্রথমত শারীরিক কসরত। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মূলত আইনের পাঠ দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে শেখানো হচ্ছে, কী ভাবে আচার-ব্যবহার করতে হবে, কথাবার্তা বলতে হবে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তার সামনে দাঁড়ালে এক জন সিভিকের আদব-কায়দা কেমন হবে, তা-ও হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে এই প্রশিক্ষণ পর্বে। সূত্রের খবর, বারংবার বলা হচ্ছে, কোনও ভাবেই সাধারণ মানুষ, পথচারী, গাড়ির চালকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।

ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ নেওয়া একাধিক সিভিকের বক্তব্য, মূলত বলা হয়েছে, পুলিশের ‘সহকারী’ হিসাবেই কাজ করতে হবে তাঁদের। রাস্তায় গাড়ি ধরলে গাড়ির কোনও কাগজপত্র সিভিকেরা হাতে নিতে পারবেন না। কোনও কোনও প্রশিক্ষণে এমনও বলা হয়েছে, যদি থানার কোনও অফিসারও গাড়ির নথিপত্র হাতে নিতে বলেন, তা হলে তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিতে হবে, এটি সংশ্লিষ্ট সিভিকের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। কলকাতা হাই কোর্ট বছর দেড়েক আগে সিভিকদের জন্য যে লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছিল, তা-ও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণে।

অতীতে এই ধরনের প্রশিক্ষণ বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু কিছু থানা এলাকায় হয়েছে। কিন্তু রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় ভাবে এমন উদ্যোগ কখনও দেখা যায়নি। তেমনই জানাচ্ছেন পুলিশের প্রথম সারির কর্তারা। সেই সূত্রেই সিভিকদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, ভোটের ঠিক আগে আগে এমন প্রশিক্ষণ কেন? তা হলে কি এই আট হাজারের বেশি সিভিকের জন্য পৃথক কোনও পরিকল্পনা রয়েছে নবান্নের? তাদের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে পুলিশের একাংশ এই প্রশিক্ষণ পর্বকে ‘ইতিবাচক’ হিসাবেই দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, সিভিকেরা সরাসরি বাহিনীর অংশ না-হলেও তাঁরা বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে প্রত্যেকেরই ন্যূনতম প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সেটাই করা হচ্ছে। আবার অন্য অংশের বক্তব্য, এই পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ আসলে ‘আইওয়াশ’। কারণ, পাঁচ দিনে কোনও প্রশিক্ষণই হয় না। ফলে যা হচ্ছে, তা প্রশিক্ষণের নামে বুড়ি ছোঁয়া।

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ঘটনায় সিভিকদের নানা কাণ্ডকারখানার জন্য মুখ পুড়েছে পুলিশের। কোথাও সরাসরি তোলাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন সিভিক ভলান্টিয়ার। আবার কলকাতার এক্সাইড মোড়ে সাধারণ নাগরিককে রাস্তায় ফেলে পেটাতেও দেখা গিয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারকে। গত বছরই পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় এক নাবালককে ‘চোর’ অপবাদ দেওয়ায় নাম জড়িয়েছিল স্থানীয় সিভিকের। পরে সেই নাবালক আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তবে সিভিক ভলান্টিয়ারের আইন ভাঙার ঘটনা এবং দাদাগিরিতে জড়িত থাকার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল আরজি কর হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন যে সঞ্জয় রায়, তিনি পেশায় ছিলেন কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার। আপাতত তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে জেলবন্দি।

রাজ্যের বিরোধী দলগুলি সিভিকদের বড় অংশকে ‘শাসকদলের ভাড়াটে বাহিনী’ বলে তোপ দেগে থাকে। তারা বলে, ভোটের সময় এই বাহিনীকে কাজে লাগায় শাসকদল। বস্তুত, পুলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে বহুলাংশের সিভিকের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। রাস্তাঘাটে ‘দাদাগিরি’ এবং আইনের শাসনের অজুহাত দেখিয়ে পথচারী বা গাড়িচালকদের হেনস্থার অভিযোগও প্রচুর। যদিও গত কয়েক বছরে সিভিকে এমন অনেক নিয়োগ হয়েছে, যা দলীয় পরিচয়ের বাইরে। গ্রাম, মফস্সলে ক্রীড়াক্ষেত্র থেকেও বহু তরুণকে সিভিকে নিয়োগ করেছে পুলিশ। তবে পুলিশের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকেরাই একান্ত আলোচনায় মেনে নেন যে, পর পর একাধিক ঘটনায় সিভিকদের ভাবমূর্তি সম্পর্কে জনমানসে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। ভোটের আগে সেই ‘বদনাম’ ঘোচাতেই কি এমন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদক্ষেপ? মুচকি হাসলেও সরাসরি জবাব দিচ্ছেন না পুলিশকর্তারা। তবে প্রায় সকলেই একান্ত আলোচনায় মানছেন, বিধানসভা ভোটের আগে আগে রাজ্য জুড়ে সিভিক ভলান্টিয়ারদের এই ধরনের প্রশিক্ষণ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

(তথ্য সহায়তা: উজ্জ্বল চক্রবর্তী)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement