নিয়ম নেই। তা সত্ত্বেও এক প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়ন করানো হল, নম্বরও বাড়ল। তা-ও আবার ফলপ্রকাশের আগে। যার জেরে শেষমেশ হবু-চাকুরের তালিকায় চলে এল প্রার্থীর নাম!
নজিরবিহীন ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)-এ। অভিযোগ, ডব্লিউবিসিএসের গ্রুপ সি’তে নিয়োগের পরীক্ষার পরে চূড়ান্ত মেধা-তালিকা তৈরিকে কেন্দ্র করে অনিয়মটি হয়েছে। ওই গ্রুপে সফল প্রার্থীদের প্রথম নিয়োগ হয় জয়েন্ট বিডিও, ল্যান্ড রেভেনিউ অফিসারের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে।
রাজ্য সরকারের আমলা থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত যাবতীয় পদে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে পিএসসি তৈরি হয়েছে কয়েক দশক আগে। স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থাটি গঠনের উদ্দেশ্যই হল, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সুনিশ্চিত করা। অথচ তারই বিরুদ্ধে এ হেন অভিযোগ ওঠায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগেই প্রার্থী কী ভাবে নম্বর জেনে নিয়ে পুনর্মূল্যায়নের আর্জি জানাচ্ছেন, এবং কোন যুক্তিতে তা গ্রাহ্য হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেছে কমিশনের কর্মী ইউনিয়ন, এমনকী, প্রশাসনেরও একাংশ।
ঘটনাটা ঠিক কী?
কমিশন-সূত্রের খবর: ২০১১-য় ডব্লিউবিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় বসেছিলেন প্রায় ৮২ হাজার প্রার্থী। পাস করেন ৩৪১৬ জন। ডব্লিউবিসিএসের চারটি গ্রুপ (এ, বি, সি, ডি) মিলিয়ে ৬৪৫ জনের চূড়াম্ত মেধা-তালিকা তৈরি হয়। সেই মতো গ্রুপ ধরে ধরে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের চাহিদা অনুযায়ী নামের সুপারিশ পাঠাতে শুরু করে পিএসসি। প্রক্রিয়াটি চলাকালীন, গত জানুয়ারির শেষাশেষি প্রশাসনকে গোপন নোট দিয়ে পিএসসি-র এক কর্তা জানান, ‘উচ্চতর কর্তৃপক্ষের’ মৌখিক নির্দেশ (৯ জানুয়ারি ২০১৪) মেনে দফতরগুলিকে নিয়োগ-সুপারিশের চিঠি পাঠানো স্থগিত রাখা হচ্ছে।
প্রক্রিয়া থমকে থাকে। আর তারই মধ্যে আসে আর একটি নোট, যা ঘিরে প্রশ্ন, অভিযোগ ও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। পিএসসি-সূত্রের খবর: গত ১৯ মার্চের ওই নোটে জানানো হয়, কমিশনের চেয়ারম্যানের নির্দেশে (আইসি-৫/২০১১-পার্ট) গ্রুপ সি-র এক পরীক্ষার্থীর পালি ভাষার প্রথম পত্রের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়েছিল। রিভিউয়ে তাঁর ১৩ নম্বর বেড়েছে। এতে পালি প্রথম পত্রে প্রাপ্ত নম্বর ৩৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯। লিখিত পরীক্ষায় মোট নম্বর ৩৩৮ থেকে হয়েছে ৩৫১। আর গোটা পরীক্ষায় তাঁর প্রাপ্ত সর্বমোট নম্বর যেখানে ৪৪৮ ছিল, পুনর্মূল্যায়নের সুবাদে তা হয়েছে ৪৬১।
বাড়তি নম্বরের জোরে প্রার্থীটির নাম মেধা-তালিকায় বেশ ক’ধাপ উপরে উঠে আসে। ফের দফতরে দফতরে নিয়োগের সুপারিশ পাঠানো শুরু হয়। তখনও অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর ভাগ্যে চাকরির শিকে ছেঁড়েনি। কারণ, নম্বর বাড়ার পরেও মেধা-তালিকায় তিনি ছিলেন ৪০৭তম স্থানে, যেখানে গ্রুপ সি পদে নিয়োগযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন ৪০৫ জন।
অর্থাৎ, ক্রমতালিকায় স্রেফ দু’ধাপের ফারাকের কারণে ওঁর চাকরির সম্ভাবনা আটকে থাকে। তবে পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায় ভূমিসংস্কার দফতরের পাঠানো এক নোটে। গত ২৬ জুনের নোটটির বক্তব্য: দফতরের হাতে পৌঁছানো তালিকার মধ্যে দু’জন লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তাঁরা কাজে যোগ দেবেন না। ওঁদের পরিবর্তে পিএসসি নতুন নাম পাঠাক।
দু’টি নাম বাদ যাওয়ায় ওই প্রার্থী এখন গ্রুপ-সি’র নিয়োগযোগ্য তালিকায় ঠাঁই পেয়ে গিয়েছেন। পিএসসি-সূত্রের খবর: চাকরির সুপারিশ করে ওঁর নাম এ বার ভূমি দফতরে পাঠানো হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে চলতি সপ্তাহেই কমিশনের ‘ফুল বেঞ্চ’ বৈঠকে বসছে। প্রসঙ্গত, পিএসসি’র ফুল বেঞ্চে কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল হক ছাড়াও রয়েছেন তিন সদস্য ডি দাশগুপ্ত, দেবপ্রিয় মল্লিক ও উমা মুখোপাধ্যায়। প্রার্থীটির উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আর্জিতে ওঁরা সকলেই অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এই পুরো ঘটনায় নিয়মভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে পিএসসি-র বিরুদ্ধে। কেন?
কর্মী ও প্রশানিক মহলের একাংশের দাবি: পিএসসি-তে লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখে নম্বর জানার সুযোগ থাকলেও পুনর্মূল্যায়নের নিয়ম নেই। কমিশনের এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান পরিষ্কার জানিয়েছেন, ফলপ্রকাশের আগে হোক বা পরে, পরীক্ষার্থীর আবেদন মেনে খাতার পুনর্মূল্যায়ন করা বা নম্বর বাড়ানোর কোনও সুযোগ নেই। ফলপ্রকাশের পরে কেউ অবশ্য তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনে খাতা দেখতেচাইতে পারেন। বস্তুত ২০১০ সালে এ ভাবেই এক পরীক্ষার্থী খাতা পেয়ে নম্বর বাড়ানোর দাবিতে কোর্টে গিয়েছিলেন। তখন আদালতকে পিএসসি বলেছিল, খাতা পুনর্মূল্যায়ন এক বার শুরু করলে শেষ হবে না। আবেদন আসতেই থাকবে। মেধা-তালিকা তৈরি ব্যাহত হবে। আদালত মামলাটি খারিজ করে দেয়।
এমতাবস্থায় কমিশনের কর্মী ও প্রশাসনিক মহলের একাংশের প্রশ্ন, ২০১১-র গ্রুপ-সি পরীক্ষার মেধা-তালিকা প্রকাশ বা দফতরে সুপারিশ পাঠানোর আগেই প্রার্থী পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করলেন কী করে? তিনি কি কোনও সূত্র থেকে আগেই নম্বর জেনে গিয়েছিলেন? তাঁর আবেদন গ্রাহ্যই বা হল কোন যুক্তিতে? পাশাপাশি ডব্লিউবিসিএসের চাকরি নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে দু’জনের তরফে ভূমি দফতরে চিঠি পাঠানোর মধ্যেও ‘আশ্চর্য সমাপতন’ দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। পাচ্ছেন রহস্যের গন্ধও। পিএসসি-র কর্মচারী ইউনিয়নের অভিযোগ, বিষয়গুলি তারা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনলেও কর্ণপাত করা হয়নি।
কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
এ সব শুনে কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল হক বিস্মিত মন্তব্য, “এমন তো হওয়ার কথা নয়! এমন কিছু আমার মনে পড়ছে না।” চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি ফাইল চেয়ে খোঁজ নেবেন, প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেবেন। কমিশনের সদস্য উমাদেবীর অবশ্য দাবি, “পিএসসি একটি পবিত্র সংস্থা। চাকরিপ্রার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে। এ রকম হতেই পারে না।” যদিও কমিশনের আর এক সদস্য দেবপ্রিয় মল্লিকের (রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা তথা তৃণমূলের সদস্য) কথায় স্পষ্ট যে, কিছু একটা ঘটেছে। কী রকম?
দেবপ্রিয়বাবু বলেছেন, “কোনও পরীক্ষার্থী যদি বোঝেন কম নম্বর দেওয়া হয়েছে, তিনি পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করতে পারেন। পিএসসি আবেদন গ্রহণ করে পুনর্মূল্যায়নের পরে নম্বর বাড়াতে পারে। এতে কোনও অন্যায় নেই।” কিন্তু পরীক্ষার্থী নম্বর জানলেন কী করে? দেবপ্রিয়বাবুর উত্তর, “আরটিআই করে জেনে যাচ্ছেন।” ফলপ্রকাশের আগেই?
দেবপ্রিয়বাবু এ বার স্পষ্ট জবাব এড়িয়ে যান। “যা করছি, স্বচ্ছ ভাবেই করছি।” দাবি করেছেন তিনি। ওঁর মন্তব্য, “আগের আমলে দলের কথায় এ সব অনেক হতো। আমরা পরীক্ষার্থীদের বক্তব্যকেই গুরুত্ব দিচ্ছি।” কিন্তু পিএসসি-র পরীক্ষায় তো পুনর্মূল্যায়নের নিয়মই নেই?
দেবপ্রিয়বাবুর জবাব, “এখন আমরা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করছি। অন্যায় কোথায়?”