দু’পক্ষে বৈঠক হল ঠিকই। কিন্তু তাতে মতবিরোধ মিটল না। বরং বন্যার জন্য এক পক্ষের অভিযোগকে একই ভাবে ফিরিয়ে দিল অন্য পক্ষ। ‘ড্রেজিং’ বা পলি তোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার নালিশকে হাতিয়ার করল রাজ্য এবং ডিভিসি, দু’পক্ষই।
রাজ্য সরকার বৈঠকে জানিয়েছে, ডিভিসি-র জলাধারগুলিতে ভাল ভাবে নজরদারি চালানো হচ্ছে না। দীর্ঘদিন কোনও ড্রেজিং হয়নি। পলি জমে জমে জলধারণের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর তারই জেরে বারবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ।
সেই অস্ত্রই ঘুরিয়ে দিয়ে ডিভিসি-র তরফে অভিযোগ তোলা হয়, তাদের জলাধারগুলোর জল যে-সব নদী ও খালবিল দিয়ে যায়, সেগুলির পলি তোলা হচ্ছে না। ওই পলি তুলে নদী-খালবিলের গভীরতা না-বাড়ালে অতিবৃষ্টি হলেই ফের ভেসে যাবে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
এই চাপান-উতোরে বন্যাদুর্গতদের কোনও সুরাহার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবে শুধু মতবিরোধেই বৈঠক শেষ হয়নি। সমস্যা মেটাতে কাল, শুক্রবার ফের দু’পক্ষ বৈঠকে বসবে বলে ডিভিসি-র তরফে জানানো হয়েছে। প্রাপ্তি বলতে এটুকুই।
রাজ্যের বন্যা-পরিস্থিতির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিভিসি-র জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়াকেই দায়ী করেছিলেন মঙ্গলবার। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের কাছেও নালিশ করেছিলেন তিনি। ডিভিসি কিন্তু বন্যার দায় নিতে চায়নি। তারা বলেছিল, ঘূর্ণিঝড় গোমেন আর অতিবৃষ্টিই বন্যার কারণ। এই মতবিরোধ কাটাতেই বুধবার দুপুরে সল্টলেকের জলসম্পদ ভবনে রাজ্যের সেচকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ডিভিসি-র চেয়ারম্যান এ ডব্লিউ কে ল্যাংস্টি।
নবান্ন সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার কেন ডিভিসি-র উপরে দোষ চাপাচ্ছে, ডিভিসি-র চেয়ারম্যানকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে ডিভিসি-র জলাধারে নজরদারির অভাব এবং ড্রেজিং না-করার কথা। ডিভিসি-র দাবি, তাদের তরফে নজরদারিতে কোনও খামতি ছিল না। উল্টে নদী ও খালবিল সংস্কারে গড়িমসির নালিশ জানায় ডিভিসি। নবান্নের খবর, অতিবৃষ্টির জন্যই যে এই বন্যা, ডিভিসি-র চেয়ারম্যান সেটা সরকারি প্রতিনিধিদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।
মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে জানান, তাঁর ফোন পাওয়ার পরেই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীর নির্দেশে ডিভিসি-প্রধান এ দিন বৈঠক করতে এসেছিলেন। ডিভিসি-র তরফে বলা হয়, ডিভিসি এবং রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতেই জলসম্পদ ভবনে যান ল্যাংস্টি। রাজ্যের দাবি, এ বার থেকে সব জলাধারে ঠিকমতো মনিটরিং (নজরদারি) হবে এবং সমন্বয় রক্ষা করে চলা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডিভিসি-প্রধান। কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘ডুবে যাওয়ার পরে মনিটরিং করে কোনও লাভ নেই!’’
বৈঠকের পরে ল্যাংস্টি দাবি করেন, গত ৫০ বছরে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধারের জলধারণ ক্ষমতা কমেছে মাত্র ১০ শতাংশ। যা সময়ের তুলনায় খুবই সামান্য। তাঁর বক্তব্য, ওই দু’টি জলাধারের ড্রেজিং নিয়ে যে কখনওই কোনও পরিকল্পনা করা হয়নি, তা নয়। কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে মাথায় রেখে একটি কমিটি গড়ে ড্রেজিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, ওই ১০ শতাংশ নাব্যতা বাড়াতে খরচ হবে ছ’হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ওই বিপুল অর্থ খরচ করে কতটা লাভ হবে, তা স্পষ্ট হয়নি। চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আজ পর্যন্ত দেশের কোনও জলাধারের ড্রেজিং হয়নি। ফলে জলাধারে ড্রেজিং করে কতটা লাভ হয়, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কারও কোনও অভিজ্ঞতা নেই।’’
ডিভিসি জানাচ্ছে, পাঞ্চেত বা মাইথনের জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়াটা বন্যার কারণ নয়। রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত দামোদরের নীচের অংশের নদী ও নালা পলি জমে বুজে যাওয়ার ফলেই বন্যা হয়েছে। কিছু জায়গায় যে নদীবক্ষ দখল হয়ে গিয়েছে, সে-কথাও বলেছে ডিভিসি।
বৈঠকে রাজ্যের তরফে অভিযোগ করা হয়, ডিভিসি-র জলাধার নজরদারি কমিটিতে রাজ্যের সেচ দফতরের এক জন আধিকারিক রয়েছেন। কিন্তু তাঁকে রাখা রয়েছে নামেই। সেচকর্তারা ল্যাংস্টিকে জানান, বৃষ্টি শুরু হতেই ওই আধিকারিক তিন দিন ধরে ভরা কোটালের বিষয়ে কমিটির অন্য সদস্যদের সতর্ক করে আসছিলেন। সেচ দফতর অনুরোধ করেছিল, ওই কোটালের সময় যেন ৩০ হাজার কিউসেকের বেশি জল ছাড়া না-হয়।
রাজ্যের অভিযোগ মানতে চায়নি ডিভিসি। তাদের দাবি, বিপর্যয়ের সময় তারা প্রায় ৬৮ শতাংশ বেশি জল মাইথন ও পাঞ্চেতে ধরে রেখেছিল। দুর্গাপুর ব্যারাজের পরে আমতা ক্যানাল (দামোদরের নীচের অংশের প্রধান নালা) ও মুণ্ডেশ্বরীর জলধারণ ক্ষমতা কমতে কমতে এক লক্ষ ৩০ হাজার কিউসেকে দাঁড়িয়েছে। যা এক সময় ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ কিউসেক। ওই সব নদীনালা সংস্কার না-করলে এর পরে একটু বেশি জল ছাড়লেই হাওড়া, হুগলির মতো জেলা প্লাবিত হবে।
কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রক সূত্রের খবর, দামোদরের নীচের অংশের নদীনালাগুলির সংস্কারের জন্য সেচ দফতর সম্প্রতি তাদের কাছে একটি প্রকল্প জমা দিয়েছে। ২৩০০ কোটি টাকা খরচ হবে ওই কাজে। রাজ্য সরকার নিজেরাও আমতা চ্যানেল ও মুণ্ডেশ্বরীর সংস্কার করতে চাইছে। কিন্তু সেই কাজ করতে গেলেও জবরদখল তুলতে হবে, করতে হবে জমি অধিগ্রহণও। সমস্যা সেখানেই।
রাজ্যের এক সেচকর্তা জানান, নিম্ন দামোদরে আমতা ক্যানাল, মুণ্ডেশ্বরী, হুরহুরা, মজা ও কানা দামোদর, ডাকাতিয়া খাল-সহ প্রায় ১২টি নদী-খাল রয়েছে। সেখানে ড্রেজিং বা বাঁধ তৈরি করা সম্ভব। ‘‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নিম্ন দামোদরের যেখান থেকে মুণ্ডেশ্বরী ও আমতা ক্যানালে জল ভাগ হচ্ছে, সেখানে প্রায় দু’লক্ষ ৭৫ হাজার কিউসেক জল ধরে রাখা যাবে। বন্যা থেকে মুক্তি পাবে হুগলি ও হাওড়া,’’ বলছেন ওই সেচকর্তা।
কিন্তু এই মুহূর্তে বন্যাদুর্গতদের কী হবে? বন্যায় নষ্ট হওয়া পরিকাঠামো তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ব্যাপারে রাজ্যের সমালোচনা করে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, কেন্দ্রের বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৫১৬ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৩ কোটি টাকা ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে রাজ্যকে। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘কেন্দ্রের পাঠানো টাকা নিয়ে দলবাজি রুখতে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ত্রাণের টাকা পাঠানোর জন্য আমরা কেন্দ্রকে অনুরোধ করেছি।’’