অসহ্য চাপে পদত্যাগ

আলাপনকে বিকল্প করে বিতর্কে রাজ্য

শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের লাগাতার চাপ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সরেই গেলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা নাগাদ রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন সুশান্ত। রাজ্য সরকারের সবুজ সঙ্কেত মেলার পরে সন্ধ্যায় রাজ্যপাল তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।

Advertisement

কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী ও পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪২
Share:

শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের লাগাতার চাপ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সরেই গেলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।

Advertisement

মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা নাগাদ রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন সুশান্ত। রাজ্য সরকারের সবুজ সঙ্কেত মেলার পরে সন্ধ্যায় রাজ্যপাল তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। নতুন কমিশনার ঠিক না-হওয়া পর্যন্ত পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভার দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভুটান সফররত আলাপনবাবু আজ, বৃহস্পতিবার বেলা বারোটা নাগাদ কলকাতায় ফিরে দায়িত্ব নেবেন বলে নবান্ন সূত্রে জানানো হয়েছে।

কিন্তু রাজ্য সরকারি অফিসার আলাপনবাবু কী ভাবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকতে পারেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৯৪ সালের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইনের ৩ নম্বর ধারার ২ উপধারা মোতাবেক রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কোনও কারণে তাঁর দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে বা পদত্যাগ করলে বা মারা গেলে রাজ্য সরকারের কোনও অফিসারকে ওই পদে বসানো যেতে পারে। স্থায়ী কমিশনার ফের কর্মক্ষম না-হওয়া পর্যন্ত বা নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ না-হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই পদে থাকবেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারের পদে থাকাকালীন ওই অফিসার রাজ্য সরকারি পদের দায়িত্বও সামলাতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।

Advertisement

নবান্নের কর্তারা নির্বাচন কমিশন আইনের উল্লেখ করে দাবি করেছেন, আলাপনবাবুর নিয়োগের ক্ষেত্রে বেআইনি কিছুই হয়নি। কিন্তু আইনজ্ঞ মহলের বড় অংশের মতে, যৌথ দায়িত্ব পালন করলে তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই নিয়োগ অবৈধ। কারণ, নির্বাচন কমিশন একটি স্বশাসিত, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা কোনও অফিসার নিরপেক্ষ ভাবে এই পদের দায়িত্ব সামলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’’ নবান্নেরই একটি সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আলাপনবাবু রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তলব করতে পারবেন। কিন্তু পরিবহণসচিব হিসেবে তো তিনি মুখ্যসচিবের অধীন। এবং সেটাই তাঁর স্থায়ী পদ। ফলে তিনি মুখ্যসচিবের অপছন্দের কাজ করবেন কি না, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠবে। আইনজ্ঞদের বক্তব্য, রাজ্যের আইনগুলি অনেক সময়ই আটঘাট বেঁধে করা হয় না। ফলে তার বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা হতেই পারে। এবং সে ক্ষেত্রে সরকারের বিড়ম্বনায় পড়ার সম্ভাবনাও বিস্তর।

প্রশ্ন হল, সরকারি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আলাপনবাবুকে অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার করা সম্ভব কি না। আইনজ্ঞদের মতে, অস্থায়ী কমিশনারের ধারণাটাই সোনার পাথরবাটি। কারণ, তাঁকে যদি ফের রাজ্য সরকারি পদেই ফিরে যেতে হয়, তা হলে কমিশনার পদে তাঁর ভূমিকার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। অশোকবাবুর বক্তব্য, সেই কারণেই নির্বাচন কমিশনার পদে কোনও অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে বসানোর কথা বলা হয়েছে। যাতে তিনি কোনও অবস্থাতেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকেন। ফলে এত দিন চোখের আড়ালে থাকা অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনারের বিষয়টি নিয়ে মামলা হলে রাজ্যের আইন ধোপে টিকবে না বলেই আইনজীবীদের বড় অংশের মত। সব মিলিয়ে কমিশনার বদলের পরেও বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে।

তবে এ দিন সরকারের বেশি মাথাব্যথা ছিল সুশান্তরঞ্জনকে নিয়েই। এ দিন রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পরে শাসক দলকে তীব্র বিড়ম্বনায় ফেলে তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘আমার পদত্যাগ করা উচিত ছিল, তাই করেছি। গত কাল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ তৃণমূলের ডেলিগেশন আমার কাছে এসেছিল। তারা গণনার একটা তারিখ ঘোষণার জন্য আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে বলছিল। আমি তারিখ ঘোষণা করে দিলাম।... কোনও রাজনৈতিক দলের তরফে এ ভাবে কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপরে চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়।’’ পদত্যাগপত্রে সুশান্তবাবু অবশ্য ‘ব্যক্তিগত কারণ’ কথাটি লিখেছেন।

স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে নতুন করে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের লাগাতার চাপেই সরতে বাধ্য হয়েছেন সুশান্তবাবু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হুমকি দিচ্ছেন, নির্বাচন কমিশনারের উপর আমরা নজর রাখছি। এক জন নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে রাজ্যের কোনও মন্ত্রী এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন?’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, ‘‘সুশান্তবাবুকে দৈহিক এবং মানসিক নির্যাতন করেছেন তৃণমূল নেতারা। ওই নেতাদের বিরুদ্ধে কেন ফৌজদারি মামলা হবে না?’’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘এত কিছুর পরে তাঁর চলে যাওয়া একটাই বার্তা দিচ্ছে— প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যদি শিরদাঁড়া সোজা করে কাজ করেন, তা হলে সেটাই মঙ্গল। কারণ তৃণমূলের আবদারের কোনও সীমা নেই!’’

সুশান্তবাবু পদত্যাগ করায় বিধাননগর, আসানসোল এবং বালি পুরসভার গণনার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে বলা হয়, সোমবার সুশান্তবাবু সাংবাদিক বৈঠক ডেকে জানিয়েছিলেন, বিধাননগর-সহ তিন পুরসভার কয়েকটি ক্ষেত্রে পুনর্নির্বাচন হবে ৮ অক্টোবর এবং ভোট গণনা হবে ৯ অক্টোবর। কিন্তু পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগে তিনি কোন বুথে পুননির্বাচন হবে বা ভোট গণনা সম্পর্কিত কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেননি। ফলে ৪ অক্টোবর সুশান্তবাবু ওই তিন পুরসভার গণনা স্থগিত রাখার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন, সেটাই বহাল থাকবে।

কমিশন সূত্রের খবর, কথা ছিল মঙ্গলবার দফতরে এসে সুশান্তবাবু আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন কোন ওয়ার্ডের কোন বুথে পুনর্নির্বাচন হবে, তা ঘোষণা করবেন। কিন্তু এ দিন অফিসেই আসেননি তিনি। লাউডন স্ট্রিটে এ দিনও সকাল থেকেই নির্বাচন কমিশনের অফিসের সামনে ধর্নায় বসেছিল তৃণমূল। আর কমিশন অফিসে কর্মীরা ঘুরছিলেন অসহায় ভাবে! কারণ আজ, বুধবার শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোট গণনা। একই সঙ্গে, কথা মতো ৮ অক্টোবর পুনর্নির্বাচন করার জন্য বা ৯ তারিখে ভোটগণনার দিন চূড়ান্ত করতে হলে এ দিনই তার নির্দেশ জারি করতে হবে। কিন্তু নানা ভাবে চেষ্টা করেও কমিশনের অন্য শীর্ষ কর্তারা কেউই উপাধ্যায়কে ধরতে পারেননি। ফলে বিভ্রান্তি ছড়ায় তাঁদের মধ্যে।

পরে অফিসের এক কর্মীকে ফোন করে সুশান্তবাবু জানান, তিনি আর অফিসে যাবেন না। খবর পেয়ে সংবাদমাধ্যমের তরফে এসএমএস করা হলে তাদেরও তিনি একই কথা জানিয়ে দেন। সন্ধ্যায় রাজ্যপাল বলেন, ‘‘সুশান্তবাবুর পদত্যাগপত্র আমি পেয়েছি। উনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার জন্য চাপাচাপি করছিলেন।’’

রাজভবন সূত্রে খবর, রাজভবনের ঠিক উল্টো দিকের সরকারি আবাসনের বাসিন্দা সুশান্তবাবু সকালে রাজভবনে যান বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানেই তিনি পদত্যাগের বিষয়টি জানান। এর পরে একটি সরকারি অনুষ্ঠানের তাঁর সঙ্গে রাজ্যপালের দেখা হয়। তাঁকেও তিনি পদত্যাগের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেন। বেলা দেড়টা নাগাদ রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন সুশান্তবাবু। রাজ্যপাল সুশান্তকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পুরো শেষ করার পরে দায়িত্ব ছাড়তে অনুরোধ করেছিলেন। সুশান্ত অনড় থাকেন। রাজ্যপাল তখন পদত্যাগপত্রটি পাঠিয়ে দেন স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে। সেখান থেকে বার্তা যায় ভুটানে। সন্ধ্যার পরে সুশান্তবাবুর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন রাজ্যপাল। তত ক্ষণে ভুটান থেকে অস্থায়ী কমিশনারের নাম এসে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন