একশো দিনের কাজ করে বছর গড়িয়ে গেলেও মজুরির টাকা মিলছে না। এলাকাবাসীর ক্ষোভের আঁচ কমাতে এবার জঙ্গলমহলের মাওবাদী প্রভাবিত ব্লকে গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নগদে একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরি মেটাতে উদ্যোগী হচ্ছে রাজ্য সরকার। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, মাওবাদী প্রভাবিত ব্লকগুলিতে নগদে মজুরি মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক দু’মাসের জন্য বিশেষ অনুমতি দিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রথম পর্যায়ে মাওবাদী প্রভাবিত ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি ব্লকের সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস গুলি থেকে বকেয়া মজুরি মেটানো হবে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদ সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেছেন, “কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক বিশেষ ছাড় দেওয়ায়, দু’মাসের জন্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সরাসরি নগদে বকেয়া টাকা উপভোক্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক স্তরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যত শীঘ্র সম্ভব পঞ্চায়েত অফিসগুলি থেকে বকেয়া মজুরি নগদে বিলির কাজ শুরু হয়ে যাবে। ৩১ অগস্ট পর্যন্ত তা মেটানো হবে।”
প্রশাসনের হিসেব বলছে, গত এক বছরে জঙ্গলমহলের তিন জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় একশো দিনের কাজের মজুরি বাবদ মোট ৪০ কোটি ২ লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে। কারিগরি সমস্যার কারণে টাকা উপভোক্তাদের ডাকঘর অ্যাকাউন্টে পৌঁছয়নি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ২০১৪-১৫ ও চলতি অর্থ বর্ষ মিলিয়ে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ২৫ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা। ঝাড়খণ্ড সীমান্ত লাগোয়া মাওবাদী প্রভাবিত বেলপাহাড়ি ব্লকে বকেয়া রয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। জামবনি ব্লকে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ১ কোটি টাকা। ঝাড়গ্রাম ব্লকে বকেয়া রয়েছে ৬১ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও গত এক বছরে রাজ্য জুড়ে এফটিও-র (ফাণ্ড ট্রান্সফার অর্ডার) মাধ্যমে গ্রাহকদের ডাকঘর অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে, এমন আরও কয়েক কোটি টাকা মাঝ পথে আটকে রয়েছে বলে অভিযোগ।
২০১৩ সাল পর্যন্ত একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা গ্রাম পঞ্চায়েতের অ্যাকাউন্টে আসত। কাজের পরে মাস্টার রোল অনুযায়ী, পঞ্চায়েতের তরফে সংশ্লিষ্ট উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের অ্যাকাউন্টে মজুরির টাকা জমা করে দেওয়া হত। মজুরি বণ্টনে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে অন লাইনে মজুরির টাকা জমা করার পদ্ধতি চালু করে। এর ফলে, গত বছর থেকে চালু হয় ফান্ড ট্রান্সফার অর্ডার (এফটিও) পদ্ধতি। এর ফলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মজুরির টাকা রাজ্য সরকারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের ডিজিট্যাল স্বাক্ষরিত হয়ে গিয়ে মাস্টার রোল অনুযায়ী উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে সরাসরি জমা পড়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে সমস্যায় পড়েন ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট থাকা উপভোক্তারা। জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে কাছে পিঠে ব্যাঙ্ক না থাকায়, ওই সব এলাকার বাসিন্দারা ডাকঘরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু অধিকাংশ গ্রামীণ ডাকঘরগুলিতে উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে অনলাইনে টাকা জমা পড়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে, উপভোক্তাদের ডাকঘর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে একশো দিনের কাজ করে কারিগরি সমস্যার কারণে গত এক বছরে জঙ্গলমহলের অধিকাংশ ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট থাকা উপভোক্তারা মজুরির টাকাই পাননি বলে অভিযোগ।
এ নিয়ে তিন জেলার জঙ্গলমহলে বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের পারদ চড়ছে। কয়েক মাস আগে বাঁকুড়ার রাইপুরে এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বকেয়া মজুরি মেটানোর জন্য পদক্ষেপ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় মাওবাদী আনাগোনা শুরু হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। এলাকাবাসীর এই ক্ষোভকে হাতিয়ার করে মাওবাদীরা তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রে বারে বারে রাজ্যকে সতর্ক করা হয়েছে।
বিধানসভা ভোটের আগে তাই আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয় রাজ্য সরকারও। কেন্দ্রের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে মাওবাদী প্রভাবিত ব্লকের প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় প্রধানের নেতৃত্বে পে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, বকেয়া মজুরির টাকা রাজ্য থেকে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের অ্যাকাউন্টে সরাসরি পাঠানো হচ্ছে। মাস্টার রোল অনুযায়ী কত বকেয়া রয়েছে, তা দেখে নিয়ে পে কমিটির তত্ত্বাবধানে তালিকা অনুযায়ী নগদে মজুরি মেটানো হবে। নগদে টাকা দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটির ভিডিও তুলে রাখা হবে।
অবশ্য সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সরব হয়েছেন ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের মুখ্য সংগঠক সুব্রত ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “নগদে টাকা বিলি হলে ফের ব্যাপক কারচুপি শুরু হবে। তাই আমরা মজুরি প্রাপকদের তালিকা বা মাস্টার রোল প্রকাশ্যে টাঙানোর দাবি করছি। বিডিও-র তত্ত্বাবধানে টাকা বিলি করা হোক। দরিদ্র আদিবাসী উপভোক্তারা বকেয়া পাচ্ছেন কি-না আমরা সে ব্যাপারে নজরদারি চালাব।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য প্রদীপ সরকার বলেন, “শাসক দলের নেতৃত্বে পঞ্চায়েতগুলি দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের আখড়া। নগদে মজুরি মেটানো হলে প্রকৃত উপভোক্তারা আদৌ পুরো প্রাপ্য টাকা পাবেন কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।”