আনন্দ পুরস্কারের প্রতীক্ষা, সাত গ্রন্থ যেন সপ্তাশ্ব

গত বছর হীরক জয়ন্তীতেই বদলে গিয়েছিল এই পুরস্কারের প্রকরণ। প্রথমে পাঁচ বিচারকের প্রাথমিক তালিকায় বিবেচিত হয় তিনটি বই। অতঃপর সেই ত্রয়ীর অন্যতম, আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ পায় শিরোভূষণ।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৪৬
Share:

(উপরে, বাঁ-দিক থেকে) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ রাণা, আশীষ লাহিড়ী, নৃপেন ভৌমিক, (নীচে, বাঁ-দিক থেকে) অমর মিত্র, কুণাল বসু, গীতা চট্টোপাধ্যায় (এঁর সাম্প্রতিক ছবি পাওয়া যায়নি)

নব কলেবরের দ্বিতীয় সংস্করণেই আনন্দ পুরস্কার এ বার সপ্তাশ্ববাহিত রথে।

Advertisement

গত বছর হীরক জয়ন্তীতেই বদলে গিয়েছিল এই পুরস্কারের প্রকরণ। প্রথমে পাঁচ বিচারকের প্রাথমিক তালিকায় বিবেচিত হয় তিনটি বই। অতঃপর সেই ত্রয়ীর অন্যতম, আনিসুজ্জামানের ‘বিপুলা পৃথিবী’ পায় শিরোভূষণ।

এ বারেও পাঁচ বিচারক। ওইটুকুই যা মিল, কিন্তু বিচারকমণ্ডলীটি নতুন। তাঁদের বিবেচনায় এ বার ১৪২৪ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের জন্য উঠে এসেছে সাতটি বই। উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, নাটক, কোষগ্রন্থ---এক বহুবর্ণ সম্ভার।

Advertisement

বাছাই-তালিকায় উঠে এসেছে ১৯টি নাটক নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকসমগ্র। সৌমিত্র অভিনয়ের জন্য এর আগে স্বদেশে, বিদেশে নানা ভাবে সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে এই প্রথম! বস্তুত, আনন্দ পুরস্কারের গত একষট্টি বছরের ইতিহাসে কোনও নাট্যকার নেই। তাঁকে বাছাই তালিকায় রেখে বিচারকেরা যেন এই পুরস্কারকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরিশ ঘোষ, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্তের ঐতিহ্যলালিত সুতোয় গেঁথে দিলেন। বাংলা নাটক সাহিত্য পুরস্কারের দরবারে পেল প্রাপ্য সম্মান।

শুধুই বাংলা? সৌমিত্র এখন অবধি প্রায় ২৯টি নাটক লিখেছেন। বেশির ভাগই বিদেশি নাটকের আদলে। নাটকসমগ্রের ভূমিকাতেও স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘বিদেশি নাটকের কাছে হাত পাততেই হয়েছে, না হলে যে থিয়েটার করার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।’ প্লটের জন্য বিদেশের কাছে হাত পাততেই হয়। শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’-র কাহিনিসূত্র ইতালীয় লেখক সিন্থিয়োর এক গল্প থেকে নেওয়া। বাংলার প্রথম ট্রাজেডি ‘কৃষ্ণকুমারী’র গল্পটির জন্য স্বয়ং মধুসূদন দত্তকেও হাত পাততে হয়েছিল টডের গ্রন্থের কাছে। বাংলার নাট্যকারেরা কখনও ছুতমার্গে ভোগেননি। সৌমিত্রও নন।

তালিকায় রয়েছে গীতা চট্টোপাধ্যায়ের ‘গদ্যসংগ্রহ’। সপ্তাশ্ববাহিত রথে একমাত্র নারী। সভাসমিতিতে তাঁকে দেখা যায় না, কিন্তু কে ভুলতে পারে তাঁর কবিতার আলোকসম উপমা: যতদূর শস্য যায় ভবিতব্যতার দিকে ভিজে পাড়ে চলে যায় শাড়ি।’ কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখেছেন বৈঠকখানা বাজারের প্রতিষ্ঠাতা সারদাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের নাতনি। শক্তি, সুনীল থেকে মণীন্দ্র গুপ্ত অনেকের কবিতা আলোচনায় ঋদ্ধ তাঁর ‘গদ্যসংগ্রহ’ এ বারের বাছাই তালিকায়।

যাবতীয় ঘাতপ্রতিঘাত নিয়ে জীবনও কি নয় বহমান কবিতা? সন্তোষ রাণার আত্মজীবনী ‘রাজনীতির এক জীবন’ও এই তালিকায়। বিপ্লবের আগুনে জারিত হতে হতে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি: এক জন মাল যুবক দশ কিমি দূরে আর একটা মাল গ্রামে গিয়ে যোগাযোগ করার ব্যাপারে স্বচ্ছন্দ, কিন্তু তার পাশের গ্রামেই কোনও তেলি বা অন্য জাতির গরিব কৃষকের সঙ্গে আলোচনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।’ কারা যেন আজও ভারতীয় সমাজে জাতপাত অস্বীকার করে শুধুই শ্রেণিহীন, শোষণহীন স্বর্গের খোয়াবনামা লেখে!

তাঁর সহপাঠিনী, প্রথম স্ত্রী জয়শ্রী জেলখানায় সন্তোষবাবুকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। জে ডি বার্নালের ‘সায়েন্স ইন হিস্ট্রি’। সেই বই ও বার্নালপুত্র মার্টিন বার্নালের কথা বারংবার ঘুরেফিরে এসেছে তালিকার আর একটি বই, আশীষ লাহিড়ীর ‘বুদ্ধিজীবীর ভাববিশ্ব সংশয়ে প্রত্যয়ে নির্মাণে বর্জনে’ বইয়ে। আশীষবাবুই একদা বার্নালের বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এই বইয়ে তিনি বার্নালের মতোই চাঁচাছোলা: সমর সেন ছাড়া আর কোন বাঙালিকেই বা রাসেল বা সার্ত্র বা চমস্কির অর্থে বুদ্ধিজীবী বলতে পারি!

নকশাল আন্দোলন ফিরে এসেছে বাছাই-তালিকায় কুণাল বসুর ‘রবি-শংকর’ উপন্যাসেও। ‘দি ওপিয়াম ক্লার্ক’ বা ‘জাপানিজ ওয়াইফ’-এর লেখক গত কয়েক বছর ধরে বাংলাতেও লিখছেন। এই উপন্যাসে বিলেতফেরত এক নকশাল ও তাকে অত্যাচার-করা পুলিশকর্মী বহু দিন বাদে একসঙ্গে। শিকারি ও শিকার পারে না পরস্পরকে এড়াতে, এক রহস্যময় বাঁধনে জড়িয়ে থাকে তারা।

তালিকায় আছে ছিটমহলের জীবন নিয়ে অমর মিত্রের উপন্যাস ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রাম, পিলার নং ৭২২ সন্নিহিত দেড়বিঘা করিডর, সব মিলিয়ে এই কাহিনি প্রথাগত বাংলা উপন্যাসের মানচিত্রকে বাড়িয়ে দিল অনেকটাই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে প্রাপ্য সম্মান দিতেই বিচারকেরা বাছাই তালিকায় রেখেছেন ডা. নৃপেন ভৌমিকের ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানকোষ’। বাঙালি একদা চমকপ্রদ রঞ্জনরশ্মির সন্ধান পেয়েছিল, এখন সবাই ‘এক্স রে’ করায়। নৃপেনবাবুদের বই বলছে, এ বার ‘অ্যাঞ্জিওগ্রাফি’র বদলে রক্তবাহচিত্রণ বললেই হয়। বিচারকদের ধারণা, রুগ্ণ বাংলা ভাষার ধমনীতেও নতুন রক্তসঞ্চার করতে পারে এই সব পরিভাষা।

চূড়ান্ত বাছাইয়ে এই সপ্তাশ্ববাহিত রথ থেকেই উঠে আসবে একটি বই। পুরস্কারের জ্যোতির্বলয়ে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন