সে বামও নেই! সে পঞ্চায়েতও নেই!
তৃণমূল জমানায় দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণা হতেই শুরু হয়েছে হিংসার দাপট। কিন্তু তার মাঝেই প্রশ্ন উঠছে, যে পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য এত হিংসা, সেই ব্যবস্থার পুরনো গৌরব বা গুরুত্ব কি আর আছে? বিরোধীরা একবাক্যে বলছেন, নেই। আর শাসক পক্ষের যুক্তি, কাজের ধরন বদলেছে। কিন্তু পঞ্চায়েতের ব্যবস্থার নিজস্ব জায়গা এখনও আছে।
বামফ্রন্ট সরকারের কাজের অন্যতম মাইল ফলক ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গোটা দেশে পঞ্চায়েতিরাজ চালু করার সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী খোলাখুলি মেনে নিয়েছিলেন, বাংলা এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত। বাম জমানায় সাত বার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে। সেই আমলেই স্বজনপোষণ, দুর্নীতি এবং হিংসা ধীরে ধীরে ব্যবস্থার মধ্যে ঘুণ ধরিয়েছে। কিন্তু তখনও জেলায় উন্নয়নের কাজে জেলা পরিষদের আলাদা গুরুত্ব ছিল। সিপিএমের দলীয় স্তরে সিদ্ধান্ত হলেও গ্রাম সংসদে অন্তত সে সব এনে পাশ করানোর রেওয়াজ ছিল। বিমল মিস্ত্রী, অপর্ণা গুপ্ত, ম্যাগদালিনা মুর্মু, অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়, উদয় সরকার, রমা বিশ্বাস, নিরঞ্জন সিহি বা বিলাসীবালা সহিসের মতো জেলা সভাধিপতিদের নাম এবং দাপটের কথা জানত লোকে। এখন জেলা সভাধিপতি খবরে আসেন মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে তিরস্কৃত হলে!
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শিবিরের একাংশের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় সরাসরি রাজ্য সরকারই পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ঘরে ঘরে। জেলায় গিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক বৈঠক করছেন। সঞ্চালনায় থাকছেন জেলাশাসক। জল নেই, চাল নেই বা রাস্তা চাই— সব চাহিদা এবং অভিযোগই উঠে যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর কানে। তিনিই কখনও জেলাশাসক, কখনও বি়ডিও-কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছেন। তা হলে আর পঞ্চায়েতের আলাদা গুরুত্ব থাকল কোথায়?
শাসক দলের নেতারাই বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, সবুজসাথী বা নিজ গৃহ নিজ ভূমি’র মতো প্রকল্প পঞ্চায়েত ভোটে তাঁদের হাতিয়ার। যা থেকেও বোঝা যাচ্ছে, নবান্নই এখন আসল পঞ্চায়েত!
এক সময়ের জেলা পরিষদ সভাধিপতি এবং প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘স্বাধিকার, বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় স্তরে গণতন্ত্র— পঞ্চায়েতের সেই ধারণা এখন আর নেই। নবান্নের কথাই এখন শেষ কথা। তবু লুঠের ভাগ নেওয়ার জন্য পঞ্চায়েত ঘিরে মারণ হিংসা চলছে!’’ একই সুরে প্রাক্তন সভাধিপতি এবং অধুনা বিজেপি নেত্রী অন্তরা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রের নানা প্রকল্প রাজ্য নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। আর দুর্নীতি এবং লুঠ বাড়ছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘এক টুকরো মাংসের জন্য অজস্র বুভুক্ষু প্রাণীর লড়াই, এটাই এখন পঞ্চায়েত ভোট!’’
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য এমন তত্ত্ব মানছেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সব দফতর মিলে নজরদারির কাজ করছেন, পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু পঞ্চায়েতের নিজস্ব কাজও আছে। তাই নির্বাচন হচ্ছে।’’ আর আমলা নির্ভরতা? মন্ত্রীর মতে, ‘‘আমলা এবং পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধি, উভয়েই কাজ করছেন। পঞ্চায়েত উঠে তো যায়নি!’’