কমছে চিঠি লেখার অভ্যাস। তাই এই চেনা ছবিও ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। ফাইল চিত্র
মন মজেছে মুঠোফোনের চক্করে। চিঠি লেখার মনকে কি নষ্ট করে দিচ্ছে সেই মোবাইলের রমরমা? আজও আছে চমৎকার সব বিকেল। কিন্তু বিকেলের ডাকে আর চিঠিরা আসে না। প্রযুক্তির বাঁক বদলে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে চিঠি লেখার মন। অথচ, স্মৃতির বসতে মন জুড়ে দু-একটি চিঠি আমৃত্যু থেকে যায়।
সত্তর দশকের কবি অরুণ চক্রবর্তী মফস্সলের এক তরুণ কবিকে পোস্ট কার্ডে কয়েকটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে ছিল কেঁদুলি মেলার কথা। বর্ধমানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি লিখেছিলেন, ‘শেষ পৌষের চিঠির পাতায় তমালতালি কম্পমান ওই খানেতে থমকে আছে আমার দেখা বর্ধমান’— সেই চিঠিটা এখনও রয়েছে কবির কাছে। চিঠি খুললেই স্মৃতির সৌরভ তাকে আবিষ্ট করে। চিঠির প্রতিটি অক্ষরকে ছুঁয়ে আছে অতীতের মায়া। মাধুর্যটা মুছে দিতে পারে না সময়। তবে আজকের ‘ফেসবুক’, ‘হোয়াটস অ্যাপ’-এর যুগে মুছে যাচ্ছে প্রিয়জনের চিঠির জন্য অপেক্ষার ছবিগুলো।
অথচ, সত্তর, আশি, এমনকী, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেও ছবিটা মোটেও এমন ছিল না। তখন দূরদেশের আত্মীয়দের খবর নেওয়ার একমাত্র ভরসা চিঠি। চিঠি বললেই মনে পড়ে যায় সেই সস্তার হলুদ পোস্টকার্ড বা নীল রঙা ‘ইনল্যান্ড’-এর কথা। সে রকম ছোট্ট পরিসরেই উজাড় করে মনের কথা লিখত মানুষ।
এমন অনেক মানুষ ছিলেন যারা নিখাদ চিঠিপ্রেমী। তেমনই এক জন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। শান্তিনিকেতন থেকে অজস্র চিঠি লিখতেন শিল্পাচার্য। সব সময়ে যে চিঠিতে শব্দের সঙ্গে থাকত নানা রং ও রেখার ‘মন্তাজ’। তাঁর লেখা চিঠিগুলিতে শান্তিনিকেতনের গাছপালা থেকে শুরু করে খোয়াইয়ের ভূপ্রকৃতি— সবই পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। পুরীর সমুদ্র থেকে ঢেউ নৌকা ও নুলিয়া— সবই ছিল তাঁর স্কেচভিত্তিক চিঠির বিষয়।
চিঠিকে শিল্প করে তোলার আর এক কারিগর ছিলেন চিত্রশিল্পী প্রকাশ কর্মকার। তিনি ভালবাসতেন নিজের আঁকা ছবি ছাপা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতে। আজকের অনেক তরুণ কবি ও চিত্রশিল্পীর সংগ্রহে তাঁর ছবি সংবলিত পোস্টকার্ড রয়েছে।
শিল্পীর ভাব প্রকাশের অমূল্য দলিল এ সব চিঠি। চিঠি লেখার চল উঠে গেলেও শিল্পীদের ভাবনার লেনদেন থেমে থাকে না। তা চলে টেলিফোনে বা ‘ফেসবুক’, ‘হোয়াটস্ অ্যাপ’-এর মতো ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য়। কিন্তু শব্দের কষ্টিপাথরকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শিল্পসুষমায় সাজানোর প্রকাশভঙ্গি তাতে অনুপস্থিত। ফলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিল্পীরাও পূর্বসূরীদের চিন্তার মণিমাণিক্যের পরিপূর্ণ রূপ দেখার সৌভাগ্য থেকে হয়তো কিছুটা বঞ্চিতই হন।
এক সময়ে বিজয়া দশমীতে চিঠি লেখার একটা রেওয়াজ ছিল। গুরুজনদের প্রণাম জানিয়ে বা ছোটদের ভালোবাসা জানিয়ে দূর দেশে থাকা আত্মীয়দের পাঠানো চিঠিগুলো আজও আমাদের স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এক সময়ে ‘বিয়েশাদি’-র নিমন্ত্রণ জানিয়ে আমার গ্রামের বাড়ি, বীরভূমের গদাধরপুর থেকে আসত গোছা গোছা চিঠি। ছোটবেলায় দেখেছি রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি ছাপানো পোস্টকার্ডে অবিভক্ত বাংলার রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া থেকে অনেক চিঠি আসত। আজ সেই সমস্ত ছবি ছাপানো পোস্টকার্ডেরা কোথায়?
তথ্যপ্রযুক্তির যে বিপ্লব আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে সময়ের দাবি মেনে বরণ করে নিয়েছি আমরা। চিঠি লিখে উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকার চেয়ে বোধহয় মোবাইলে ‘মেসেজ’ পাঠানো অনেক সহজ। তাতে দ্রুত উত্তর পাওয়া যায় আবার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া যায় উত্তরের প্রত্যুত্তর। চিঠির উত্তর না পাওয়ার মন খারাপ কখন যেন বদলে গিয়েছে ‘এখনও রিপ্লাই দিচ্ছে না কেন’-র টেনশনে। তাই যে সমস্ত ডাকঘরে প্রতিদিন পোস্টকার্ড কেনার লম্বা লাইন পড়ত, আজ সে সব ডাকঘরে মাসে পাঁচটা পোস্টকার্ডও বিক্রি হয় কি না সন্দেহ। আগামীদিনে হয়তো পোস্টকার্ডের দেখা পেতে ডাকঘরে নয়, জাদুঘরে যেতে হবে।
ইদানীং চিঠির সুদিন ফিরিয়ে আনতে নানা ব্যবস্থা করছে ভারতীয় ডাক বিভাগ। সম্প্রতি আসানসোলের ডাক বিভাগ সে কাজটাই শুরু করেছে। পোস্টকার্ডে চিঠি লেখাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা পোস্টাল স্ট্যাম্পের পাশে চিঠি লেখকের পাসপোর্ট ছবি ছাপার প্রকল্প নিয়েছিল। উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু
একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আজকে নিজস্বী তোলার যুগে ক’জন মোবাইলের ‘টাচস্ক্রিন’-এর সাহচর্য ছেড়ে ডাকঘরে ছুটবেন, নিজের পাসপোর্ট মাপের ছবি ছাপাতে। মনে পড়ছে, পোস্টকার্ডকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ২০০৮ সালে বিজ্ঞাপন ছাপা পঁচিশ পয়সার ‘মেঘদূত’ পোস্টকার্ড বাজারে এনেছিল ডাকবিভাগ। কিন্তু সে প্রকল্পেও বিশেষ কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।
এক বার যে মন মুঠোফোনে মজেছে, আর কি সে চাইবে উজানের দিকে ফিরতে? তাই আজ হাতে লেখা চিঠির অস্তিত্বের লড়াই শুরু হয়েছে। সময়ের স্রোতে সে টিকে থাকতে পারবে কি না জানি না। কিন্তু চিঠি লেখা হারিয়ে গেলে তার সঙ্গে হারাবে একটা যুগ, একটা সংস্কৃতি।
লেখক কবি ও চিত্রশিল্পী