দৌড়ে রয়েছে ২৯টি রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২৬ তম!
রক্তের উপাদান বিভাজনের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই রাজ্যে আপাতত শেষের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
এটা কোনও অভিযোগ নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য থেকেই এ রাজ্যের করুণ ছবিটা উঠে এসেছে। ২০১৫-১৬ সালের রিপোর্টে তারা জানিয়েছে, এ রাজ্যের ৬০টি সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে সংগৃহীত মোট রক্তের মাত্র ৪৩%-এর বিভাজন হয়। সোজা কথায়, রোগীদের কাজে লাগে। বাকি রক্ত ‘হোল ব্লাড’ হিসাবেই ব্যবহার করা হয়, ডাক্তারি পরিভাষায় যাতে রোগীর ভালর চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এবং পর্ষদের রিপোর্ট অনুযায়ী, মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যও রক্তের উপাদান বিভাজনের কাজে পশ্চিমবঙ্গকে কয়েক যোজন পিছনে ফেলে দিয়েছে। এই কাজে ১০০% সক্ষম হয়ে উঠেছে ছোট রাজ্য মণিপুর। আবার, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের মতো বড় রাজ্যের ধারেকাছেও নেই পশ্চিমবঙ্গ।
অথচ এ রাজ্যে রক্তের কোনও আকাল নেই। এখন রক্ত দিলে চোখ ধাঁধানো উপহার মিলছে। তাই বিশেষত জেলাগুলিতে সরকারি উদ্যোগে রক্তদান শিবিরেরও ঘাটতি নেই। কিন্তু এত রক্তের উপযুক্ত ব্যবহার নেই— বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কেন? চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, রক্তদাতার শরীর থেকে যেটা নেওয়া সেটা ‘হোল ব্লাড’। সেই রক্তকে উপাদান বিভাজন কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে লোহিত কণিকা, প্লাজমা, প্লেটলেট আলাদা করা হয়। থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের প্রয়োজন হয় লোহিত কণিকার, ডেঙ্গি রোগীকে দেওয়া হয় প্লেটলেট। ‘‘প্রতিটি রোগের ধরন দেখে রক্তের উপাদান ঠিক করা হয়,’’ বলেন এক চিকিৎসক।
কিন্তু হোল ব্ল্যাড বা পুরো রক্ত শরীরে গেলে বিপদ হতে পারে। কী রকম? চিকিৎসকেরা বলছেন, কোনও থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে লোহিত কণিকার পরিবর্তে ‘হোল ব্লাড’ দিলে তা কিডনিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। লিউকেমিয়ার রোগীকে হোল ব্লাড দিলে তার অন্য সমস্যা দেখা দেবেই। ডেঙ্গি রোগীকেও হোল ব্লাড দিলে তাঁর শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, হোল ব্লাডের ব্যবহার কমে আসছে। রক্তের
অপচয় রুখতে এটা খুব জরুরিও। কারণ, উপাদান আলাদা করা গেলে এক জনের রক্ত বাঁচাতে পারে একাধিক প্রাণ।
এই ‘জরুরি’ ক্ষেত্রটিতেই পশ্চিমবঙ্গ বেশির ভাগ রাজ্যের কাছে দশ গোল খেয়ে বসে আছে। ডাক্তাররা বলছেন, প্রতিটি ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গেই রক্তের উপাদান বিভাজন কেন্দ্র থাকা উচিত। এ রাজ্য তার ত্রিসীমানায় নেই। জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের ২০টি জেলার মধ্যে কলকাতা, শিলিগুড়ি, মালদহ, বাঁকু়ড়া ও বর্ধমানে রক্তের উপাদান বিভাজন কেন্দ্র রয়েছে। এখানে যে ৪৩% রক্তের উপাদান বিভাজন হয়, তার মাত্র ১২% হয় জেলার কেন্দ্রগুলিতে। বাকিটা কলকাতায়। অর্থাৎ, জেলাগুলির হাল আরও খারাপ।
রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের রিপোর্ট নিয়ে আপত্তি না তুললেও রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, ‘‘৪৩% নয়, এখন রক্তের বিভাজন হচ্ছে বেশি। আগে শুধু কলকাতায় বিভাজন কেন্দ্র ছিল। এখন জেলাগুলিতেও হয়েছে। তবে বিভাজন কেন্দ্রগুলিতে কর্মীর অভাব রয়েছে। আদালতে মামলা থাকায় নতুন নিয়োগ করা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে।’’
চিকিৎসকদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার বিচারে এ বছর প্রথম স্থানে রয়েছে এ রাজ্য। ডেঙ্গি রোগীকে সুস্থ করতে প্রয়োজনীয় প্লেটলেট দুষ্প্রাপ্য। বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ, ‘‘এখানে উৎসবের মেজাজে উপহার দিয়ে রক্তদান চললেও তার অনেকটাই চিকিৎসার কাজে লাগছে না।’’
ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘যে রাজ্যে ডেঙ্গি, থ্যালাসেমিয়ার এত রোগী, সেখানে এই জীবনদায়ী পদার্থের ব্যবহার বাড়ানোর কথা সরকারকে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।’’ হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রক্তের উপাদান বিভাজন ঠিক মতো হলে এক ইউনিট থেকে তিন জন চিকিৎসা পেতে পারেন’’ মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার মনে করেন, ‘‘রক্ত থাকতেও তার উপাদান বিভাজনের উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় বহু রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা সরকারের দেখা উচিত।’’
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যথেষ্ট সংখ্যক উপাদান কেন্দ্র না থাকা চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। মুম্বইয়ের মতো শহরে ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরির সময়েই রক্তের উপাদান বিভাজনের পরিকাঠামো তৈরি হয়। কলকাতা সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।’’