এ বার ভোটে অস্ত্র কত ‘লট’

পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম বা মঙ্গলকোট, বীরভূমের নানুর, লাভপুর মুর্শিদাবাদের ডোমকল, পশ্চিম বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর, হিরাপুরের বাসিন্দারা জানেন, ভোট এলেই তাঁদের এলাকা তেতে ওঠে। টুকরোটাকরা সংঘর্ষ আকারে-প্রকারে বেড়ে যায়।

Advertisement

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:০৮
Share:

উদ্ধার হচ্ছে এ ধরনেরই দেশি নাইন এমএম পিস্তল। —নিজস্ব চিত্র।

ভোট মানেই বন্দুক— আইনে সিদ্ধ না হলেও সাক্ষী গণতন্ত্র। পঞ্চায়েত ভোট ঠিক কবে হবে তা নিয়ে আলোচনা যেই একটু একটু করে আকার নিচ্ছে, রাজ্য পুলিশ মহলে শুরু হয়েছে তৎপরতা— বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের। কিন্তু কেমন করে উদ্ধার হবে তা জানতে চেয়ে রাঢ় এবং মধ্যবঙ্গে শোনা গেল নানা মত। মতের ফারাক রয়েছে পুলিশের অন্দরেই। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে যে কথা মানতে পুলিশ কর্মীদের দ্বিধা নেই, তা হল রাজ্যে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা খুব কম নয়। ভোটের মুখে সেটা মাথা ব্যথার কারণ হতেই পারে।

Advertisement

পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম বা মঙ্গলকোট, বীরভূমের নানুর, লাভপুর মুর্শিদাবাদের ডোমকল, পশ্চিম বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর, হিরাপুরের বাসিন্দারা জানেন, ভোট এলেই তাঁদের এলাকা তেতে ওঠে। টুকরোটাকরা সংঘর্ষ আকারে-প্রকারে বেড়ে যায়। বন্দুক-বোমার ব্যবহার বাড়ে। ভিন্-রাজ্য থেকে আসা অস্ত্রের জোগান বৃদ্ধি পায়। পুলিশ সূত্রের দাবি, দেশি পদ্ধতিতে তৈরি নাইন মিলিমিটার পিস্তল তার একটা বড় অংশ। ‘বেরেটা’ বা ‘গ্লক’-এর মতো কুলীন না হলেও পুলিশকর্তারা মানছেন, সে আগ্নেয়াস্ত্র কম মারাত্মক নয়।

কী ভাবে উদ্ধার হচ্ছে সে অস্ত্র? রাঢ়বঙ্গের এক পুলিশকর্তা জানালেন, নিজস্ব ‘নেটওয়ার্ক’-এ তাঁরা জানছেন, কার কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে দেখা হচ্ছে, অস্ত্র মালিকের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার কোনও অভিযোগ রয়েছে কি না। যদি দেখা যায়, তেমন কোনও অভিযোগ নেই, তা হলে লোকটি জেনেশুনে সে অস্ত্র কিনলেন কেন খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

Advertisement

ওই পুলিশ-কর্তার কথায়, ‘‘অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাড়ায় হয়তো একটি দুষ্কৃতীর কাছে পিস্তল আছে। সে সেটা দেখিয়ে লোকজনকে চমকে বেড়ায়। তাতে প্রভাবিত হয়ে তার সমবয়সী আরও কিছু ছেলেও ওই পিস্তল কিনেছে। অথচ, সেই ছেলেগুলো সমাজবিরোধী নয়। স্রেফ হুজুগে অস্ত্র কিনেছে।’’ সে জেলায় এমন লোকেদের বেছে নিয়ে, স্বেচ্ছায় অস্ত্র সমর্পণ করার সুযোগ দিচ্ছে পুলিশ। অস্ত্র জমা দিলে তৎক্ষণাৎ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সতর্ক করা হচ্ছে। অস্ত্র জমা দেওয়া ব্যক্তির উপরে পুলিশের নিয়মিত নজরদারি থাকছে। বেচাল দেখলে শুরু করা হচ্ছে অস্ত্র আইনে মামলা। সে জেলায় এমন ভাবে শ’দুয়েক বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।

তৎক্ষণাৎ আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ? জেলা পুলিশের সেই কর্তার যুক্তি, অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম বারের অপরাধী সংশোধনাগারে গিয়ে পোড় খাওয়া অপরাধী হয়ে ওঠে। বুঝিয়ে বিপথে যাওয়া থেকে তাদের নিরস্ত করা গেলে আখেরে লাভ।

কিন্তু অস্ত্র উদ্ধারের এই পদ্ধতির সঙ্গে সহমত নন মধ্য বঙ্গের এক পুলিশ কর্তা। তিনি জানাচ্ছেন, কেবল মাওবাদীদের জন্য অস্ত্র সমর্পণ করার সরকারি প্রকল্প রয়েছে। সে প্রকল্পে সমর্পণকারীর জন্য কিছু আইনি ছাড়ও রয়েছে। বেআইনি অস্ত্র কাছে রাখলে, মালিকের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা ছাড়া অন্য রাস্তা দেখছেন না ওই পুলিশ-কর্তা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আইন মেনে কড়া পদক্ষেপ করলে লোকে ভয় পাবে। তাতে অস্ত্র রাখার মানসিকতা গোড়াতে নষ্ট হয়ে যাবে।’’

নরম এবং কড়া—আইনের এমন পাকের মাঝামাঝিও একটি মত রয়েছে। রাঢ়বঙ্গের আর এক পুলিশ-কর্তা সে মতের পক্ষে। তিনি জানাচ্ছেন, বেআইনি অস্ত্র রাখলে তাঁরা অনেককে সরাসরি অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করেন। আবার অস্ত্র উদ্ধারের স্বার্থে অপরাধীকে বার্তা পাঠানোর বেসরকারি পন্থাও রয়েছে।

ওই পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘কোনও এক নেতার চেলা-চামুণ্ডার কাছে বেআইনি অস্ত্র রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেল। নেতা লোকটির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আমরা তাঁর মাধ্যমে অপরাধীদের সতর্কবার্তা পাঠালাম। বার্তাবাহকের মাধ্যমেই বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হল। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের জন্য হুঁশিয়ারি দিয়ে কাজ হাসিল হয়ে গেল।’’ শুধু ‘ওয়ান শটার’ (পাইপগান), পিস্তল বা রিভলভার নয়, এই পদ্ধতিতে বোমাও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তিনি।

অস্ত্র উদ্ধারের এই তিন পদ্ধতির মধ্যে তৃতীয়টি যে প্রায় বছরভর চলে, সে দাবির সমর্থন মিলেছে রাজ্য পুলিশের নিচুতলার সূত্রে। কনস্টেবল, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর (এএসআই)-দের একাংশের বক্তব্য, কর্তারা অস্ত্র উদ্ধার করতে বললে এলাকায় তাঁদের যে ‘সোর্স’ ওই ব্যবসার খুঁটিনাটি জানে, তার সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু সেই ‘সোর্স’কে কর্তাদের সামনে আনা হয় না। পাছে, তার বিরুদ্ধেও অস্ত্র আইনে মামলা করতে হয়। কারণ যদি মামলা করা হয়, সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীর পক্ষে পরবর্তীকালে খবর জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার কোনও ‘প্রভাবশালী’ নেতার কথায় বেআইনি অস্ত্রধারী তাঁর সঙ্গীকে ‘দেখতে না পাওয়া’র রীতিও চালু রয়েছে।

গত পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার পর্বে রাঢ়বঙ্গেরই এক নেতার মুখে পুলিশকে বোমা মারার আহ্বান শুনেছে এ রাজ্য। তার পরে পাঁচ বছর কেটেছে। রাজ্যে শাসকের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বেড়েছে। সশস্ত্র টক্কর দেওয়ার হুমকি শোনা গিয়েছে বিরোধীদের একাংশের মুখেও।

এই পরিস্থিতিতে পুলিশ বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে কোন রাস্তায় হাঁটবে? নিচুতলার পুলিশকর্মীরা জানাচ্ছেন, ভোটের কথা ‘আলাদা’। সে সময় নির্বাচন কমিশনের ‘ঠেলায়’ কে হুজুগে অস্ত্র কিনেছে, কে ‘সোর্স’, কে পেশাদার অস্ত্র ব্যবসায়ী, দালাল বা মজুতদার— বাছবিচার করা হয় না। ধরে জেলে পোরা হয়। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের আগেও তেমনই হবে। তবে তাতেও সমস্যা রয়েছে। এক এএসআইয়ের কথায়, ‘‘আমরা ভোটের আগে লটে অস্ত্র ধরি। এ বারেও ধরব। তবে এ বার কত লট ধরতে হবে এখনও বোঝা যাচ্ছে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন