আলিপুর আদালতে ঢোকার সময়। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
কেউ তাঁকে বলছেন ‘স্বমহিমায়’। কেউ বলছেন, ‘সংযত’। কেউ আবার মনে করছেন, আলিপুর আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের সামনে তাঁর এ দিন পরের পর সপাটে উত্তরের কোনও ‘বিশেষ তাৎপর্য’ রয়েছে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। সারদা মামলায় জেলবন্দি মদন মিত্রের বৃহস্পতিবারের কোর্ট-যাত্রার পর এমনই নানা চর্চা চলল রাজ্য রাজনীতির অন্দরমহলে।
১৪ দিনের জেল হেফাজতের মেয়াদ শেষে আদালতে হাজিরা দিতে আসা মদন এ দিন খোশমেজাজেই ছিলেন। বৃহস্পতিবার আর তাঁর জামিন চাননি আইনজীবীরা। আরও দু’সপ্তাহের জন্য জেলেই ফিরেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। কিন্তু পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে নিজে থেকেই সাংবাদিকদের বলে গিয়েছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যেটা করেন, ভালর জন্যই করেন। অতএব মুকুল রায় এবং শিউলি সাহার ব্যাপারে তাঁর যে সিদ্ধান্ত, তা মানুষের জন্য, বাংলার জন্য অত্যন্ত ভাল সিদ্ধান্ত।’’
নেত্রীর প্রতি অটুট আস্থা, নাকি অন্য তাৎপর্য রয়েছে এই মন্তব্যের?
বছরখানেক আগে প্রথম যখন গ্রেফতার হন, তখন কোর্টে হাজিরার সময়ে নিয়ম করে নেত্রীর নামে জয়ধ্বনি দিতেন রাজ্যের তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভ্যাসে ইতি টানেন। ক্রমশ কোর্টের শুনানিতে তাঁর কৌঁসুলির মুখেই এক দিন উঠে আসে দলনেত্রীর নাম। শোনা যায়, তার পর থেকেই একদা বিশ্বস্ত সতীর্থের থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকে মমতার। এমনকী মদনের জামিন প্রাপ্তি ও খারিজ নিয়ে নীরবই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
মদনের প্রথম দফার বন্দিদশার প্রায় পুরোটাই জেলের বদলে কেটেছিল হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে। তবু শেষ দিকে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি মদন তীব্র অভিমান উগরে দিতেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি।
জামিন খারিজ হওয়া ইস্তক তাঁর দ্বিতীয় দফার বন্দিদশা কাটছে জেলেই। দিন কয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রী হাওড়ার প্রশাসনিক সভায় বলেছিলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে কেউ দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে দল তার দায় নেবে না!’’ মদনই এই মন্তব্যের লক্ষ্য কি না, জল্পনা শুরু হয়েছিল তা নিয়ে। মদনের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘ঠিকই তো বলেছেন।’’ সেই মন্তব্যে অভিমান দেখেছিলেন অনেকেই। তবে এ দিন মদনের কথায় অন্তত প্রকাশ্যে কোনও ক্ষোভ বা অভিমানের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের একাংশের বক্তব্য, কয়েক মাসের নীরবতা কাটিয়ে প্রকাশ্যে দলনেত্রীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন মদন।
কী বলেছেন তিনি?
চার দিক থেকে ছুটে আসা প্রশ্নের উত্তরে কাটা কাটা জবাব দিয়েছেন। ‘লুজ’ বল পেলেও বেমক্কা চালাননি। খেলেছেন সোজা ব্যাটে। কোনওটা আবার স্রেফ ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন, তাঁর পাশে দলের না দাঁড়ানো বা পরিবারের সঙ্গে নেতাদের দেখা না করা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককেই প্রশ্ন করেছেন, ‘‘দল পাশে দাঁড়ায়নি কে বলল? আপনার সঙ্গে আমার দলের শীর্ষ নেতাদের এই নিয়ে বৈঠক হয়েছে নাকি?’’ প্রশ্ন ছিল, দলনেত্রী কি সারদার ব্যাপারে কিছু জানেন? মদনের উত্তর, ‘‘এত কাগজে বেরোচ্ছে। সবাই জানে। আপনারা আরও লিখুন ভাল করে!’’ মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই-কে সাহায্য করবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারবেন। আমি কী বলব!’’
পরনে হলুদ পাজামা-সাদা পাঞ্জাবি। কড়া পুলিশি পাহারায় এ দিন অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক সৌগত রায়চৌধুরীর এজলাসে ঢোকার মুখে সকলকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ জানান মদন। তার পর এজলাসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন আইনজীবীদের সঙ্গে। বড় ছেলে স্বরূপকে দেখা যায় তাঁর কানে কানে কথা বলতে। মদনের অন্যতম আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় আর্জি জানান, ৩১ অক্টোবর আলিপুরের অবকাশকালীন আদালত মদনের জামিন মঞ্জুর করলেও তাঁর পাসপোর্ট এবং জামানতের ১ লক্ষ টাকা জমা রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। জামিন খারিজ হওয়ায় মদন ফের জেলে। সুতরাং তাঁর পাসপোর্ট ও জামানতের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দিক আদালত। মদনের আইনজীবীরা জানান, বিচারক ইতিমধ্যেই সেই নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সিবিআই তা শোনেনি। এ দিন বিচারক সেই আবেদন ফের মঞ্জুর করলেও মদনকে ফের ১৪ দিনের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
সবিস্তারে দেখতে এখানে ক্লিক করুন..
তবে সারদা মামলার এ সব সওয়াল-জবাব ছাপিয়ে দিনের শেষে আলোচনার কেন্দ্রে রয়ে গিয়েছে কোর্টে ঢোকা-বেরোনোর পথে সাংবাদিকদের সঙ্গে মদনের ঝটিতি কথোপকথন। যেখানে মুকুল রায় নিয়ে ‘স্পর্শকাতর’ প্রশ্নের উত্তরেও তিনি কৌশলে আস্থার বার্তা দিয়েছেন নেত্রীর উদ্দেশে।
প্রশ্ন হল, কেন?
কেউ কেউ বলছেন, দল ও নেত্রীর সম্পর্কে প্রকাশ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করেননি বলেই জমি ফিরে পেতে শুরু করেছেন মুকুল। মদনও হয়তো তাই ভাবছেন, প্রকাশ্যে নেত্রী সম্পর্কে ইতিবাচক কথাবার্তা বললে দূরত্ব কমবে। তবে এর মধ্যেও আর এক অংশ বলছেন, ‘‘মদনদা যা বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা ভালই। কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে কোনও শ্লেষ আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।’’
খুব একটা অমূলক হয়তো নয় এই ‘সন্দেহ’। প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ‘মুকুল রায়কে দলে ফেরানো হল। আপনাকে কি বলির পাঁঠা করা হল?’
মদন উত্তর দিয়েছেন, ‘‘আমাকে কি ছাগল মনে হয়!’’