শিল্প আনতে সিপি কেন, প্রশ্ন বিরোধীদের

শিল্প বাজেট নিয়ে বিধানসভায় আলোচনা। সেখানে অবধারিত ভাবেই এসে গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন্ন লন্ডন সফরের কথা। কাজেই প্রশ্ন উঠল, মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরের উদ্দ্যেশ্য যদি হয় রাজ্যে লগ্নি-আকর্ষণ করা, তা হলে সেখানে কলকাতার পুলিশ কমিশনার কেন? মমতা-সরকারের আমলে গত চার বছরে রাজ্যের শিল্প-বিনিয়োগের চেহারাটা যে অত্যন্ত বিবর্ণ, তা শুধু বিরোধীরা নন, বারেবারে উঠে এসেছে বিভিন্ন বণিক সভার প্রতিনিধিদের কথাতেও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

শিল্প বাজেট নিয়ে বিধানসভায় আলোচনা। সেখানে অবধারিত ভাবেই এসে গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন্ন লন্ডন সফরের কথা। কাজেই প্রশ্ন উঠল, মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরের উদ্দ্যেশ্য যদি হয় রাজ্যে লগ্নি-আকর্ষণ করা, তা হলে সেখানে কলকাতার পুলিশ কমিশনার কেন?

Advertisement

মমতা-সরকারের আমলে গত চার বছরে রাজ্যের শিল্প-বিনিয়োগের চেহারাটা যে অত্যন্ত বিবর্ণ, তা শুধু বিরোধীরা নন, বারেবারে উঠে এসেছে বিভিন্ন বণিক সভার প্রতিনিধিদের কথাতেও। লগ্নি টানতে ফি বছর রাজ্যে শিল্প সম্মেলন করা অথবা দলবল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কখনও দিল্লি, কখনও মুম্বই কখনও সিঙ্গাপুর সফরের পরেও যে কাজের কাজ কিছু হয়নি— তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট বলে মনে করেন প্রশাসনের একাংশও। এই অবস্থায় আগামী মাসে মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরকে সামনে রেখে সরকারপক্ষকে চেপে ধরলেন বিরোধী সদস্যরা।

মঙ্গলবার বাজেট-বক্তৃতায় যোগ দিয়ে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘লন্ডন সফরে পুলিশ কমিশনারকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা, নাকি সে দেশের শিল্পপতিরা রাজ্যে আসতে না চাইলে পুলিশ কমিশনার তাঁদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসবেন?’’

Advertisement

শমীকবাবুর এই তীব্র কটাক্ষে হইচই করে ওঠেন শাসক দলের বিধায়কেরা। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে বিজেপি বিধায়ক এর পর রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার ছৌ-এর মুখোশ, বাঁকুড়ার নারকেল মালার তৈরি ভূতের মুখ, বর্ধমানের ডোকরার বাঁকা সৈনিক, বেলডাঙার গামছা সবই গিয়েছিল সিঙ্গাপুরে। কিন্তু এল কী? রাজ্যবাসী সেটা জানতে চায়।’’ শমীকের মতোই সরকারকে বিঁধতে ছাড়েননি কংগ্রেসের মানস ভুঁইঞাও। মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর পর পর বিদেশ সফর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছর কত টাকা লগ্নি আসছে, তার হিসেব পেশ করছে না সরকার। অথচ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন, বেঙ্গল লিডস, সিঙ্গাপুর সফর, চিন সফর, লন্ডন সফর হয়ে চলেছে!’’ ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সমীক্ষার কথা তুলে মানসবাবু বলেন, ‘‘যে সব রাজ্যে শিল্পে লগ্নি থমকে গিয়েছে, তার সর্বাগ্রে আছে পশ্চিমবঙ্গ! তা হলে কীসের জন্য এই বিদেশ যাত্রা?’’ তাঁর দাবি, স্পষ্ট জমি নীতি, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, রাস্তা খারাপ, শ্রমিক অসন্তোষের কারণেই রাজ্যে শিল্প আসছে না।

তৃণমূলের একদা জোটসঙ্গী এসইউসি-র বিধায়ক তরুণ নস্কর বলেন, ‘‘শিল্প-সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি না করলে শিল্প সম্মেলনও বিনিয়োগ আসবে না।’’ সিপিএমের গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট আমলের শেষ বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছিল। এই সরকার স্পষ্ট ভাবে বিনিয়োগের হিসেবই দিচ্ছে না! শিল্প-বাণিজ্য দফতর তাদের বার্ষিক রিপোর্টও প্রকাশ করেনি।’’ পরে বিধানসভার বাইরে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘একই ব্যক্তি শিল্প এবং অর্থমন্ত্রী— ভূভারতে এমন নজির নেই! এতেই স্পষ্ট, এই সরকার লগ্নি টানতে কতটা তৎপর!’’

যাঁর উদ্দেশে এত প্রশ্ন, কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন বিরোধীরা, সেই শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র লন্ডন সফরে পুলিশ কমিশনারের যাওয়া-সহ একাধিক প্রসঙ্গে কার্যত টুঁ শব্দটি করেনি! শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের সমস্যা, সিঙ্গুর, শালবনিতে জিন্দালদের প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিরোধীদের তোলা প্রশ্নেরও কোনও জবাব দেননি তিনি। এমনকী গত আর্থিক বছরে রাজ্যে প্রকৃত বিনিয়োগ কত, তা নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্নের জবাবে লগ্নি হতে চলেছে এবং হয়েছে— এমন দুই হিসেবকে একসঙ্গে জুড়ে সভায় একটি তথ্য পেশ করেন তিনি! তবে, বিরোধীদের দাবি মেনে রাজ্যে প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ কত, আলাদা করে তা আর জানাননি তিনি।

অমিতবাবুর দাবি, ‘‘গত চার বছরে ৪৩৫টি ক্ষেত্রে হয় লগ্নি হয়েছে অথবা লগ্নি প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে ৮৪ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে অথবা হতে চলেছে। তাতে ২ লক্ষ ২৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।’’ লগ্নির উদাহরণ হিসেবে তিনি হলদিয়ার মিৎসুবিশি কারখানার সম্প্রসারণ, গ্রেট ইস্টার্ন এনার্জি, আমূল, স্কুমি এবং অন্ডাল বিমানবন্দরের প্রসঙ্গ তোলেন। যা শুনে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলেন, মালয়েশিয়ার স্কুমি সংস্থাটি কোথায় এবং তারা কোন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, তা স্পষ্ট নয়। একই সঙ্গে তাঁরা বলেন, স্কুমি ছাড়া বাকি কোনও লগ্নিই তৃণমূল আমলের নয়।

রাজ্যে বিনিয়োগের তালিকায় অ্যামিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেআইএস বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির উল্লেখ করেন অমিতবাবু। যা শুনে বিরোধীদের কটাক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নতুন বিনিয়োগ হলে বৃহস্পতিবার উচ্চশিক্ষা দফতরের বাজেট-বক্তৃতায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় কী বলবেন? এই অবস্থায় যাঁর কাছ থেকে শিল্প দফতর কেড়ে নিয়ে অমিত মিত্রকে দেওয়া হয়, সেই পার্থবাবু শিল্পমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রমে রাজ্যে বিনিয়োগ আসছে। বিরোধীরা তা মানতে পারছেন না। তাই সিঙ্গাপুর থেকে লন্ডন সফর নিয়ে কটাক্ষ করছেন।’’

অমিতবাবুর দাবি, সিঙ্গাপুর থেকে রাজ্য অনেক কিছু পেয়েছে। চাঙ্গি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অন্ডালে তাদের অংশীদারিত্ব বাড়িয়েছে। জিআইসি-র মতো মূলধনী সংস্থা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরের পরে তা সম্ভব হয়েছে। গত জানুয়ারিতেও বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে যে ২ লক্ষ ৪৩ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব এসেছিল, তার মধ্যে প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও এ দিন দাবি করেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন