Gorkhaland Bridge

দার্জিলিঙে নদীর উপর নির্মিত ‘গোর্খাল্যান্ড সেতু’! ওপারে কী? ভোট-বিজয়ের লক্ষ্যে এক পা করে এগোচ্ছেন এডওয়ার্ড অজয়

বছর চারেক আগে অজয়ের তৈরি করা হামরো পার্টি দার্জিলিং পুরসভা দখল করে চমক দিয়েছিল পাহাড়ের রাজনীতিতে। তার পর যদিও ভাঙাগড়ার খেলায় সেই ক্ষমতা হাতছাড়া হয় তাঁর। সেই দলও ভেঙে যায়।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:০০
Share:

বিতর্কিত সেই সেতু। পাশে অজয় এডওয়ার্ড। —ফাইল চিত্র।

ব্যবধান মাত্রই তিন মাসের। উত্তরবঙ্গের দুর্যোগের সময়ে তিন মাস আগে ভেঙে পড়েছিল দার্জিলিঙের দুধিয়া সেতু। তিন মাস পর সেই দার্জিলিঙেরই বিজনবাড়িতে নতুন একটি সেতু তৈরি হয়ে গিয়েছে। নাম ‘গোর্খাল্যান্ড সেতু’। তা-ও আবার সরকারি অর্থ ছাড়াই। চাঁদা তুলে।

Advertisement

আপাতত সেই সেতু ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে পাহাড়ের রাজনীতি। টাইগার হিলে সুর্যোদয়ের মতো আবার নতুন করে ভেসে উঠছে পুরনো নাম— অজয় এডওয়ার্ড। কিন্তু এই সেতুর ওপারে কী আছে?

ভৌগোলিক ভাবে সেতুর এক দিকে বিজনবাড়ি ব্লকের মূল ভূখণ্ড। অন্য পারে টুংসুং চা বাগান। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে টুংসুংখোলা নদী। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন যখন আসন্ন, তখন এ হেন সেতু নির্মাণ প্রত্যাশিত ভাবেই নানা জল্পনায় জল-হাওয়া দিচ্ছে। যা দেখে পাহাড়ের রাজনীতিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ করা প্রায় সব পক্ষই একবাক্যে বলছেন, সেতুর ওপারে ভোট আছে। যেখানে মাথা তুলতে চাইছেন অজয়।

Advertisement

বছর চারেক আগে অজয়ের তৈরি করা হামরো পার্টি দার্জিলিং পুরসভা দখল করে চমক দিয়েছিল পাহাড়ের রাজনীতিতে। তার পর যদিও ভাঙাগড়ার খেলায় সেই ক্ষমতা হাতছাড়া হয় তাঁর। দলও ভেঙে যায়। ইন্ডিয়ান গোর্খা জনশক্তি ফ্রন্ট নামের নতুন দল গড়েছেন অজয়। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে নবনির্মিত সেতুর সঙ্গে অজয়ের দলের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতির ওয়াকিবহালদের মতে, ওটি আসলে ‘অজয় সেতু’। ভোটের আগে মানুষের সঙ্গে সংযেগের সোপান। যাতে মিশে রয়েছে স্থানীয় আবেগ— ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দবন্ধ।

সেতুর এ হেন নাম নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সরকারের অনুমতি ছাড়া সেতু নির্মাণের কারণে ঠিকাদারকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে প্রশ্ন উঠছে, আস্ত একটি কংক্রিটের সেতু তো এক দিনে গড়ে ওঠেনি! সময় লেগেছে। যখন নির্মাণ শুরু হল, তখন প্রশাসন কী করছিল? চলতি সপ্তাহের গোড়ার দিকে এই সেতুর উদ্বোধন করেন অজয়। কাকতালীয় যে, ঠিক তার পরেই দার্জিলিংয়ের আবগারি শাখা অজয়ের ‘গ্লেনারিজ় পানশালা’ বন্ধ করার নোটিস জারি করেছে। যার নেপথ্যে ‘রহস্য’ দেখছেন ব্যবসায়ী অজয়।

উত্তরবঙ্গের প্রাক্তন এক মন্ত্রীর বক্তব্য, পাহাড়ের রাজনীতিতে যদি কাউকে জমি পেতে হয়, তা হলে ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দ রাখতেই হবে। অজয়ও সেই কৌশলই নিয়েছেন। বর্তমান শাসকদল তৃণমূল অবশ্য গোটা ব্যাপারটা দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে চাইছে। রাজ্যের এক বর্তমান মন্ত্রীর কথায়, ‘‘অজয়ের প্রতিপত্তি রয়েছে। তবে দার্জিলিং বাদ দিয়ে পাহাড়ের বাকি দুই বিধানসভায় তাঁর কোনও প্রভাব নেই। কিন্তু পাহাড়ের রাজনীতির বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী অনীত থাপাদেরই দেখতে বলেছেন। তাই এ ক্ষেত্রে আমরা দর্শক।’’

ওয়াকিবহালদের অনেকের বক্তব্য, দার্জিলিং শহরে অজয়ের প্রভাব রয়েছে পারিবারিক কারণে। কিন্তু গ্রামে সেই প্রভাব নেই। তাই তিনি পাহাড়ের গ্রামীণ অংশে জনভিত্তি তৈরি করতে চাইছেন। নতুন করে উস্কে দিচ্ছেন ‘গোর্খাল্যান্ড’ আবেগ। যা গত কয়েক বছর ধরে স্তিমিত রাখতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। অজয়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অধিকাংশই কংগ্রেসপন্থী। সেই সূত্রে তিনিও পাহাড়ের রাজনীতিতে তৃণমূল এবং বিজেপির মিত্রশক্তির বাইরে বিকল্প অক্ষ তৈরি করতে চাইছেন। ‘গোর্খাল্যান্ড সেতু’ তার একটি উদাহরণ মাত্র।

মমতার শাসনে পাহাড়ে নানাবিধ সমীকরণ দেখা গিয়েছে। প্রথমে ‘বাঘ’ হয়ে উঠেছিলেন বিমল গুরুং। তাঁর পরে পাহাড়ের নেতা হয়ে ওঠেন বিনয় তামাং। বিনয় তৃণমূলেও যোগ দিয়েছিলেন। তার পরে তিনি তৃণমূল ছেড়েও দিয়েছেন। পাহাড় থেকেই শান্তা ছেত্রীকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল বাংলার শাসকদল। কিন্তু তিনিও রাজনীতির মূলস্রোত থেকে কার্যত হারিয়ে গিয়েছেন। এমন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও পাহাড়ের তিন বিধানসভায় রাজনৈতিক জমি এখনও শক্ত করতে পারেনি তৃণমূল। কিন্তু পাহাড়ের প্রশাসনকে ‘গতিশীল’ রাখতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা। যে কারণে একদা গুরুংয়ের আধিপত্য ভাঙতে যে ১৬টি উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করেছিল রাজ্য সরকার, সেগুলি ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়া হয়েছে। মাথায় বর্তমান জিটিএ প্রধান অনীত।

আপাতত অনীতের চোখ দিয়েই পাহাড় দেখেন মমতা। অনীতরাও অতীতের মতো গোর্খাল্যান্ডের বিষয়ে সরব নন। কিন্তু সেই পুরনো শব্দবন্ধকেই সেতুর সঙ্গে বেঁধে পাহাড়ে ভোটের গা ঘামানো শুরু করে দিলেন অজয়। ক্ষমতায় আসার পরে মমতার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জঙ্গলমহল এবং পাহাড় ‘ঠান্ডা’ করা। জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রে সাফল্য পেলেও পাহাড়ের ক্ষেত্রে নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। গুরুংয়ের মতো নেতার হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পর গোড়ায় সব ঠিকঠাক থাকলেও পরে সমস্যা তৈরি হয়। তবে গত কয়েক বছর দৃশ্যতই ‘পাহাড় হাসছে’। কোনও গোলমাল নেই।

এ হেন আপাত শান্ত পাহাড়ে নতুন একটি সেতু নির্মাণ রাজ্য সরকারকে ভাবিয়ে তুলছে। তবে দেখার বিষয় একটাই, কংক্রিটের সেতু ধরে অজয় ভোটের সেতু গড়তে সমর্থ হন কি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement