অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
হেথা হতে যাও পুরাতন...।
পুরাতনকে এ ভাবে বিদায় জানানোই যেত। কিন্তু ২০২০ বিদায়বেলায় আরও ‘দুচ্ছাই’ পাওয়ারই যোগ্য।
এমন একটা বছরকে ক্যালেন্ডার থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, শিহরণ, মনখারাপ, বিচ্ছেদ, শোক, ঘাবড়ে যাওয়ায় ভরপুর এ রকম বছর আগে কখনও আসেনি। তবে খারাপ সময়ও তো শিক্ষা দিয়ে যায়। সেটুকুই দিয়ে গেল ‘বিষ সাল’। ছোট ছোট ভাণ্ডে রাখা একটা মস্ত বড় শিক্ষার ভাণ্ডার। তার কতকটা ভুলে যাওয়ার। আর বাকিটা নিয়ে সরাসরি ২০২১-এ ঢুকে পড়া।
তার আগে ঢুকে পড়া যাক অভিধানে। শব্দগুলো নিয়ে। প্যান্ডেমিক, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, কোয়রান্টিন, আইসোলেশন, আনলক, কোমর্বিডিটি, কন্টেনমেন্ট জোন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ভার্চুয়াল, সেফ হোম আরও কত কী! অন্য কিছু শব্দও গোটা করোনাকালে বাঙালির সুজন হয়েছে। হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি। আর্সেনিক অ্যালবাম এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। বাঙালির জীবনে এ ভাবে শব্দগুলো একমাত্রায় জড়িয়ে যায়নি কখনও। বাঙালি তার বাংলা প্রতিশব্দ নতুন করে ভাবতে বসেছে। অতিমারি, সামাজিক দূরত্ব, নিভৃতবাস ইত্যাদি শব্দ বছরভর মুখে মুখে ঘুরেছে। ঘুরছে। দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে। এ সব শব্দের ব্যবহার নতুন বছরেও থেকে যাবে। ভোলা যাবে না সমাজযাপনে তাদের অভিঘাত।
বিষময় একটা বছর আলোকবর্তিকাও দেখিয়েছে। ছবি: পিটিআই।
বাঙালি কোনও কালেই স্বাস্থ্যসচেতন ছিল না। তারা ভিড়ে মুখচাপা না দিয়েই হাঁচি-কাশিতে অভ্যস্ত। যত্রতত্র থুতু ফেলাতেও কোনও অপরাধবোধ নেই। কিন্তু গোটা ২০২০ কেউ সামান্য হাঁচি-কাশি দিলেই তার দিকে ঘুরঘুর করেছে অবিশ্বাসী চোখ। সে দশা কাটেনি। তবে অতিমারি শিখিয়েছে, হাঁচি-কাশির সময় মুখের সামনে নিদেনপক্ষে হাতটা রাখতে হয়। রাখা উচিত। সর্বত্র থুতু ফেলা যায় না। মুখে মাস্ক রাখা চাই। হাতে সাবান বা স্যানিটাইজার দিতে হয়। বাইরের হাত মুখে দিতে নেই। নতুন বছর তো বটেই, এ সব অভ্যাস আজীবন থাকা উচিত। কিন্তু বাঙালি তাতেই বা কবে তোয়াক্কা করেছে! অনেক মুখই কিন্তু মুখোশহীন বছর শেষের প্রকৃত ছবিতে।
প্রকৃত আর ‘ভার্চুয়াল’ কি সমনামী? অফিসের বৈঠক। প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা। বন্ধুত্বের আলিঙ্গন। জন্মদিনের কেক কাটা। প্রধানমন্ত্রীর সভা। রাজনৈতিক কর্মসূচি। পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন। সব, সবই বিষ বছরে ভার্চুয়াল। নতুন বছরে এই ‘ভার্চুয়াল’ বরং ‘অ্যাক্চুয়াল’ আসুক। তবে বাঙালি শিখে গিয়েছে, আড়ালের অন্য নাম অনলাইন।
অনলাইনে ক্লাস করা যায়, পরীক্ষা দেওয়া যায়, শিক্ষক পড়াতেও পারেন। এর আগে ইউটিউবে এমন চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক ‘জ্ঞান’-এর ভিডিয়ো সেখানে রয়েছে। প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীরা চোখ বুলিয়েছে। কিন্তু বাঙালি আবার সাহচর্য সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল। অতিমারি দিল সব ঘেঁটে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ার টোল থেকে প্রাইভেট টিউটর— সকলের দরজা বন্ধ। খোলা শুধু অনলাইন। মাধ্যম হিসাবে খুবই উত্তম। জরুরি তো বটেই। আপৎকালীনও। কিন্তু সকলের কাছে পৌঁছনোর মতো পরিকাঠামো দেশে নেই। তাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, মূল স্রোত থেকে প্রান্তিক— সকল নাগরিক যদি নতুন বছরে এমন পরিকাঠামোর ভিতরে চলে আসতে পারে, তা হলে ভুলে না-গিয়ে ‘অন’ থাকুক এই চেনাজানা।
নতুন বছরে এমন আশ্চর্য উৎসব-কাল কাটাতে চাইবে না বাঙালি। ছবি: পিটিআই।
চেনাজানার বৃত্তে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে অতিমারি। যে পরিবর্তন দেখিয়েছে, পুলিশ অপারগের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে পারে। গান গেয়ে করোনা সচেতনতা বাড়াতে পারে। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দোকান থেকে কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে পারে। খারাপ সময় চিনিয়ে দিয়েছে মানবিক পুলিশকে। নতুন বছরেও নিশ্চয়ই আইনরক্ষার পাশাপাশি পুলিশ নাগরিকের পাশে দাঁড়াবে সঙ্কটের সময়।
করোনা-সময়ে অদ্ভুত শারদীয়া কাটিয়েছে বাঙালি। মণ্ডপে ভিড় নেই। শুধু প্রতিমা। রাস্তায় দর্শনার্থী নেই। শুধু পুলিশ। করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বলে দিওয়ালিতে আতশবাজিও তেমন ভাবে পোড়ানো হয়নি। নিন্দুকেরা বলবে আদালতের নির্দেশ ছিল। কিন্তু বাঙালির সদিচ্ছা ছিল না, বলা যাবে না। বাঙালির ইদও ম্যাড়মেড়ে করে দিয়েছে অতিমারি। বাঙালি রমজানের মাসে সন্ধেবেলা তারাবির নমাজ মসজিদে গিয়ে না পড়ে বাড়িতে বসে পড়েছে! জুম্মাবারেও বন্ধ থেকেছে মসজিদ! নতুন বছরে এমন আশ্চর্য উৎসব-কাল কাটাতে চাইবে না বাঙালি। ভুলে যেতে চাইবে উদ্যাপনের একাকিত্ব।
খেলার মাঠে পৃথিবী জুড়ে একের পর এক টুর্নামেন্ট, লিগ বন্ধ হয়েছে। পিছিয়ে গিয়েছে অলিম্পিক। বছরের শেষদিকে যখন চালু হল খেলাধুলো, তখন মাঠ দর্শকহীন। টিভিতে কৃত্রিম চিৎকার। কিন্তু ঘোলে আর কতটা দুধের স্বাদ পাওয়া যায়! শুরুর একটা শুরু হয়েছে বটে। কিন্তু নতুন বছরে খেলার আসর পুরোদমে বসবে তো? গ্যালারি ভর্তি দর্শক থাকবে তো?
দর্শক নেই বলে অনেকগুলো সিঙ্গল স্ক্রিন আনলক পর্বেও বন্ধ করে দিতে হল। ‘জনতা কার্ফু’র পর পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স, থিয়েটার, অডিটোরিয়াম, রেস্তরাঁ, পার্ক— বিনোদনের সব দরজা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রমরমা বেড়েছে লকডাউন পর্বে। একের পর এক সিনেমা রিলিজ করেছে সেখানেই। গৃহবন্দি দর্শকদের কাছে খুলে গিয়েছে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের ব্যক্তিগত পরিসর।
আরও পড়ুন: মারাদোনার বিদায়, খেলার দুনিয়ায় শেষতম মৃত্যু-অভিঘাতটাই নিষ্ঠুরতম
আরও পড়ুন: বলি থেকে টলি, ২০২০ সালে ‘ভুল’ কারণে খবরে যাঁরা
কাজের পরিসরেও বড়সড় বদল এনে দিয়েছে কোভিড-১৯। এক দল লোকের কাজ একেবারে চলে গিয়েছে। এক দলের কাজকর্মের গোটাটাই চলছে বাড়ি থেকে। তৃতীয় একটা দল মধ্যপন্থায়। অফিস দরকার মনে করে ডেকে পাঠায়। আর এক দলের কাজের ধরনটাই পাল্টে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের এক বইবিক্রেতা এখন প্লাস্টিক কারখানায় রাত জেগে খেলনা বানান। দিনের বেলা সেই তিনিই দোকানে দোকানে পাঁউরুটি-লাড্ডু-বিস্কুট ফেরি করেন। রোজগার হয়েছে ৩ ভাগের এক ভাগ। বেসরকারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ভিন্রাজ্যে কাজে যাওয়া ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের কাজ হারিয়ে বেঁচে থাকা আর ঘরে ফেরার গল্প আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।
কাজের দুনিয়ায় বড়সড় বদল এনে দিয়েছে কোভিড-১৯। ছবি: পিটিআই।
একটা দীর্ঘ সময় মানুষ বাড়িতে বন্দি ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তার বাইরে বেরনো বারণ। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন সেটুকুই কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসা। সেই কেনাকাটার ফাঁকেই বাঙালি বেদম ভিড় বাড়িয়েছে বাজারে। সামাজিক দূরত্বের দফারফা করে ছেড়েছে। কিন্তু বাকি সবই ঘরে বসে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে বেরোলেই পুলিশের ধমক, মার, অন্যের ভ্রূকুটি। তাতেই বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে। গোটা দুনিয়ায় চলতে থাকা নিয়ম-কানুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে। বিষময় একটা বছর শুধু অদ্ভুত এক আঁধার পথে হাঁটিয়েছে, তা নয়। আলোকবর্তিকাও দেখিয়েছে। গোটা বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা সেখানেই। পরিবারকে সময় দেওয়া। অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পুরনোকে ভুলে সেই বাড়ানো হাত ধরেই যাওয়া যাক নূতন বছরে।
হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে...।