পরপর পার্টি কংগ্রেস হয়ে চলেছে দক্ষিণ ভারতে। দলের নেতৃত্বেও দাপট দক্ষিণের। আর বাংলায় শাসক দলের মোকাবিলা করতে গিয়ে আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকেরা। সংগঠনেও ধাক্কা প্রবল। এই অবস্থায় বাংলায় দলকে চাঙ্গা করতে সিপিএমের সাংগঠনিক প্লেনাম কলকাতায় করতে উৎসাহী সীতারাম ইয়েচুরি। বাংলার নেতারা আগেই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে রেখেছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে তাঁর প্রথম কলকাতা সফরে ইয়েচুরিও তাঁর উৎসাহের কথা আলিমুদ্দিনকে জানিয়ে দিয়েছেন।
দেশ জুড়েই দলের সংগঠনে যে ধস নেমেছে, তার ময়না তদন্ত করে পুনরুজ্জীবনের সম্ভাব্য দাওয়াই খুঁজে বার করার লক্ষ্যে এ বার সাংগঠনিক বিশেষ অধিবেশন বা প্লেনাম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। বিশাখাপত্তনমে সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে যে কারণে সংগঠন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়নি। পার্টি কংগ্রেসের অবসরেই এ রাজ্যের সিপিএমের তরফে সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসুরা জানিয়ে দিয়ে এসেছিলেন, কলকাতায় প্লেনাম আয়োজনে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। এর পরে রবিবার আলিমুদ্দিনে এসে ইয়েচুরি বাংলায় সংগঠনের হাল নিয়ে আলোচনা সেরেছেন সূর্যবাবুদের সঙ্গে। তিনিও মনে করছেন, বিধানসভা ভোটের আগে কলকাতায় প্লেনাম এ রাজ্যের সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের জন্য টনিক হিসাবে কাজ করতে পারে। পুরভোটের সময় তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে বাংলায় দলের জন্য এক প্রস্ত বার্তা দিয়েছেন ইয়েচুরি। ধারাবাহিক ভাবেই এখন তিনি বাংলার পাশে দাঁড়াতে চান।
দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, ‘‘বাংলায় এখন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে দলকে। শাসক দলের হাতে প্রতিদিন আমাদের কর্মীরা আক্রান্ত। এই অবস্থায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় প্লেনাম কর্মীদের চাঙ্গা করতে সাহায্য করবে।’’ তা ছাড়া, কলকাতায় ওই অধিবেশন হলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সেখানে অংশ নিতে পারবেন। স্বয়ং ইয়েচুরি অবশ্য এই নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য, ‘‘নতুন পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকে বসে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’’ শেষ পর্যন্ত এ রাজ্যেই প্লেনাম হলে সিপিএমের ইতিহাসে সালকিয়ার (১৯৭৮) পরে আবার পশ্চিমবঙ্গের নাম উঠবে।
সংগঠনে রক্তসঞ্চার করতে প্লেনামের জন্য আলাদা কিছু পরিকল্পনা আছে নতুন সাধারণ সম্পাদকের। নতুন প্রজন্মকে ফের বামেদের দিকে টেনে আনা তাঁর কাছে অন্যতম ব়ড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে গঠিত নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারুণ্যের অভাব নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ইয়েচুরি-ঘনিষ্ঠ অরুণকুমার এবং দিল্লিতে কৃষক সংগঠন সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত বিজু কৃষ্ণন ছাড়া কমিটিতে কোনও তরুণ মুখের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি! ওই দু’জন স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য হয়েছেন। বাকি ১৭ জন নতুন সদস্যের মধ্যে সেই অর্থে কোনও তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নেই। সিপিএমের সংগঠনের ব্যবস্থা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটিতে অবশ্য চট করে খুব তরুণ মুখের স্থান পাওয়া কঠিন। তবু দলের একাংশের বক্তব্য, তাপস সিংহের মতো তুলনায় তরুণ নেতা হাতের কাছে ছিলেন। যিনি ১২ বছর দলের সর্বভারতীয় যুব সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। অথচ যুব সম্পাদকের দায়িত্ব ছাড়ার পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে না পাঠিয়ে রাজ্য কমিটি ঘুরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! ইয়েচুরিও ইতিমধ্যে টের পেয়েছেন, কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে এই রকম কিছু অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ দলে চর্চা হচ্ছে। বিশেষত, প্রশ্ন উঠেছে বাংলা থেকেও।
এ রাজ্য থেকে এ বার কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাওয়ার দৌড়ে ছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী। ইয়েচুরি নিজেও চেয়েছিলেন সুজনবাবু কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসুন। কিন্তু একই সঙ্গে জেলা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কমিটি— তিন স্তরের সদস্য হওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যেই একাংশ আপত্তি তুলেছিল। তাদের যুক্তি, গৌতম দেবের পরে আবার একই রাজ্য থেকে আর এক জেলা সম্পাদকের জন্য এমন অনুমতি দৃষ্টিকটু। অথচ বীরভূমের জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোমের একই অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে চলে গিয়েছেন! রামচন্দ্রবাবুর সদস্য হওয়া নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেন না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এক এক জনের জন্য এক এক রকম নীতি কেন হবে? রাজ্যে মহিলা সমিতির সম্পাদক মিনতি ঘোষের পরে আবার সভানেত্রী অঞ্জু কর কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ায় দলেরই একটা বড় অংশ বিস্মিত! কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ রাজ্যের এমন কিছু সদস্য আছেন, যাঁদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেই জায়গায় আরও নতুনদের সুযোগ করে দেওয়া হল না কেন, প্রশ্ন সেখানেই।
প্রশ্ন এবং অভিযোগের কথা জানলেও ইয়েচুরি এই বিষয়ে মন্তব্যে যেতে নারাজ। তবে পলিটব্যুরোর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘৯১ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি আর বাড়ানোর জায়গা নেই। এর মধ্যেই কিছু অদল-বদল করা সম্ভব কি না, প্লেনামের সময় দেখা যেতে পারে।’’