IVLP

রাজাবাজার থেকে মার্কিন দেশে সাহস-সরণি 

গত বছরের শেষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ভিজ়িটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম’ উপলক্ষে প্রথম বার সাত সাগর তেরো নদীর পারে ওয়াশিংটনগামী বিমানে চড়ে বসেন সাহিনা জাভেদ।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২০ ০২:১৪
Share:

একসঙ্গে: নারী অধিকার রক্ষাকর্মীদের একটি দলের সঙ্গে সাহিনা জাভেদ। আমেরিকার ওহায়ো স্টেটের অ্যাক্রন শহরে। নিজস্ব চিত্র

রাজাবাজারের তস্য গলি থেকে ভিক্টোরিয়া স্কুল পর্যন্ত একা যাতায়াতেই ঘোর আপত্তি ছিল মা-বাবার। তাই তার থেকে এক ক্লাস নিচুর পড়ুয়া সহোদরটিকে অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়েছিল সেই কিশোরীবেলায়।

Advertisement

সদ্য তিরিশের কোঠায় ঢোকা সেই মেয়েই কি না একা আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছে। গত বছরের শেষে ‘ইন্টারন্যাশনাল ভিজ়িটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম’ উপলক্ষে প্রথম বার সাত সাগর তেরো নদীর পারে ওয়াশিংটনগামী বিমানে চড়ে বসেন সাহিনা জাভেদ। পুরনো কথা মনে পড়ে তখন তাঁর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলছিল।

অনেকটা একই রকম হাসিতে তাঁর চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়েছে দিল্লির হাড়-কাঁপানো শীতে শাহিন বাগের ‘দাবাং দাদিদের’ বীরগাথা গোটা দেশ জুড়ে প্রথম প্রচারিত হওয়ার সময়ে। কয়েক প্রজন্ম ধরে কখনও চার দেওয়ালের চৌহদ্দির বাইরে পা না-রাখা রাজাবাজারের ঘরোয়া মেয়েদেরও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জীবনযুদ্ধের মন্ত্রই তো তিনি শিখিয়ে চলেছেন গত পাঁচ-ছটা বছর ধরে।

Advertisement

কলকাতার তথাকথিত প্রান্তিক পল্লি রাজাবাজারে ঘর-সংসার সর্বস্ব মেয়েদের জীবনে চিরকেলে ছক ভাঙার কাজটাই করে চলেছেন সাহিনা। এ যাবৎ পর্দানশীন মেয়েদের ফুটবল খেলা কিংবা ট্যাক্সি চালানোর কাজে নিয়ে আসার পাশাপাশি গৃহহিংসার জুলুমের বিরুদ্ধেও সজাগ করে তুলছেন সাহিনা ও তাঁর সহযোদ্ধারা। রোশনী বলে মেয়েদের একটি দল গড়ে লিঙ্গ বৈষম্যের দেওয়াল ভাঙার এই যুদ্ধের গল্প এ বার আমেরিকাতেও পৌঁছে গিয়েছে। নিজেদের লড়াই মেলে ধরেছেন, আরও কঠিন লড়াই লড়ার রসদ নিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছেন অদম্য সাহিনা জাভেদ।

আমেরিকার বিদেশ দফতরের তরফে নানা ক্ষেত্রে বিশ্বের তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে সেতুবন্ধনের একটি উদ্যোগ এই ভিজ়িটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম। এই কর্মসূচিতে শামিল হওয়া নামগুলির মধ্যে দুনিয়ার প্রায় সব দেশেরই কোনও রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিদের ভিড়। এমন নামজাদা মঞ্চে তিনটি সপ্তাহ কাটিয়ে ফিরে কলকাতার ঘুপচি গলির মেয়ে বলছেন, ‘‘কত কিছু শিখলাম! আগে মেয়েদের খেলার মাঠ দখলে বাধা থেকে শুরু করে নানা কারণে তেড়েফুঁড়ে ঝগড়া করতাম। এখন আগের থেকে বেশি ধৈর্য ধরতে শিখেছি। ঝামেলাবাজদের ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করি।”

সমস্যা আমেরিকাতেও নেই, তা নয়! সাহিনার আফশোস, হোয়াইট হাউস, মার্কিন সেনেট থেকে শুরু করে ক্যালিফর্নিয়া, ওহায়ো, ফ্লোরিডা কত জায়গায় ঘুরেও মার্কিনমুলুকে প্রান্তিকদের মধ্যে প্রান্তিক আদি বাসিন্দা নেটিভ ইন্ডিয়ানদের কারও সঙ্গে দেখা হল না! আমেরিকার কালো মেয়ে টিফ্যানি এখন সাহিনার প্রাণের বন্ধু। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেই সাহিনা বুঝেছেন, ভারতের রক্ষণশীল পরিবারে মেয়েদের সমস্যাটা ঘরে-বাইরে ঢের বেশি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘আমেরিকায় পুরুষ-নারীতে অত ভেদ নেই। কলকাতাতেও মেয়েদের ঘিরে সেকেলে ধ্যানধারণার ছড়াছড়ি। এখানে মেয়েদের চলার পথটা তাই আরও বেশি কাঁটা-বিছানো।’’

তবে নরম কিন্তু দৃঢ় স্বরে ঠিক কথাটি ঠিক সময়ে শুনিয়ে দিতে এখন শিখে গিয়েছেন সাহিনা। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবাদের আসর রাজাবাজারের শিরিন বাগে এক তৃণমূল নেতা ঠাট্টা করে মেয়েদের বলছিলেন, আপনাদের স্বামীদের না-জ্বালিয়ে এ বার কিছু দিন মোদীকে জ্বালিয়ে দেখান! সাহিনা তাঁকে সবিনয় বলেন, ‘‘এমন রসিকতা করবেন না, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক মেয়ের জীবনে গৃহহিংসার বাস্তবতা বরং মনে রাখুন!’’ আর এক জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আন্দোলনরত মেয়েদের সুরক্ষায় বারবার ছেলেদের তৎপর থাকতে বলছিলেন। তাঁর উদ্দেশেও সাহিনার আর্জি, ‘‘মেয়েদের দুর্বল ভাববেন না, সম্মান করুন, সুরক্ষার দিকটা তাঁরা একসঙ্গে ঠিকই সামলে নেবেন।’’ নারী বা তৃতীয় লিঙ্গ, সব গোত্রের সব ধর্মের প্রান্তিকতাকে সম্মানের কথাই বলছেন রাজাবাজারের মেয়ে।

এ বার আমেরিকার ফ্লোরিডার পেনসাকোলা শহরে অতিথি হয়ে গিয়ে সাম্মানিক নাগরিকত্ব পেয়েছেন সাহিনা। নিজেকে মনেপ্রাণে এক জন বিশ্বনাগরিকই তিনি ভাবেন। তবু রাজাবাজারে নিজের ‘কৌমের’ মেয়েদের হাত ধরেই মুক্তির লড়াই চালিয়ে যেতে নাছোড় কলকাতার তরুণী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement