অশোকস্তম্ভের চতুর্থ সিংহ

জেলা বর্ধমান, গ্রাম ভাটাকুল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদই রাস্তা শুনশান, কারণ রোদ স্বয়ং তার আস্তিন গুটিয়ে গ্রীষ্মের প্রচারে নেমেছে। আমার সঙ্গে রয়েছে ফ্রেন্ড এবং গাইড অংশুমান, নির্বাচনের বাস্তব মাটিতে ফিলোজফারের কোনও ভূমিকা আপাতত দেখছি না। ও বর্ধমানের বাসিন্দা, টাউন থেকেই সঙ্গী হয়েছে আমার। কারণ শহরের বাইরে আমার ভৌগোলিক চেতনা বিশেষ সুবিধের নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪০
Share:

জেলা বর্ধমান, গ্রাম ভাটাকুল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদই রাস্তা শুনশান, কারণ রোদ স্বয়ং তার আস্তিন গুটিয়ে গ্রীষ্মের প্রচারে নেমেছে। আমার সঙ্গে রয়েছে ফ্রেন্ড এবং গাইড অংশুমান, নির্বাচনের বাস্তব মাটিতে ফিলোজফারের কোনও ভূমিকা আপাতত দেখছি না। ও বর্ধমানের বাসিন্দা, টাউন থেকেই সঙ্গী হয়েছে আমার। কারণ শহরের বাইরে আমার ভৌগোলিক চেতনা বিশেষ সুবিধের নয়।

Advertisement

দিগন্ত অবধি শুয়ে থাকা ধানখেত পেরিয়ে অনেকটা পথের পর এই গ্রাম। এখানে গাড়ি দেখলে এখনও লোকজন ভিড় করে আসে, অথচ কথা বলতে ভয় পায়। গ্রামে ঢোকার মুখে চোখে পড়ল, চারটে দলের দখলেই বেশ কিছু দেওয়াল রয়েছে। বেশির ভাগই মাটির দেওয়াল, তবু রয়েছে। এক কিলোমিটারের মধ্যে তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি সবই। এক কালে বামফ্রন্টের দুর্জয় ঘাঁটি, পরে আমূল বদলে গিয়ে মা-মাটি। এ হেন বর্ধমানের ভেতরকার হাওয়া এখন ঠিক কী, সেটা জানার কৌতূহল ছিল। কিন্তু শুরুটা হল অপ্রত্যাশিত ভাবেই।

পাড়ার মোড়ে ছোট মতো একটা মন্দিরে ম্যারাপ বাঁধার কাজ চলছে। সামনেই সংকীর্তনের আসর বসবে। কয়েক জন তরুণ সেখানে হইহল্লা করেই কাজ করছেন। ভোটের নাম শুনেই প্রথমে একটু গুটিয়ে গেলেন। তার পর সাহস জোগাতেই এক জন বললেন, “সেই পনেরো বছর আগে এক বার রাস্তা হয়েছিল, তার পর সেই যে ভেঙেছে, আর মেরামত হয়নি। কেউ অসুস্থ হলে গাড়ি ঢোকে না, রুগিকে মাথায় করে তুলে আনতে হয়। ভোটের কথা ভেবে আমরা কী করব?” “তা হলে দেবেন না ভোট?” পাল্টা প্রশ্ন করি আমি। ‘‘ভোট তো দিতেই হবে”, মুখ খোলেন আর এক জন। “এ বার বিজেপিকে একটা চান্স দিতে হবে।” অ-নির্বাচনীয় আমার সফরে এই প্রথম বিজেপির সমর্থনে কারও কথা শুনলাম, তাও খোদ বর্ধমানের মাটিতে। ‘‘বিজেপি এলে ভাল হবে দেশের?’’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে আর এক জনের জবাব, ‘‘ঘুরেফিরে সরকার হচ্ছে তো! এ বার মোদীকে সুযোগ দেওয়া দরকার!”

Advertisement

বেশ বিস্ময় নিয়েই গ্রামের ভেতরে ঢুকলাম। মেয়েদের ভোটাধিকার ও সরকার তৈরিতে সেই অধিকারের প্রভাব নিয়ে রমরমিয়ে চায়ের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই সব প্রভাবশালী মেয়ে ভোটাররা কি গ্রামীণ ভারতের বাসিন্দা? মনে হল না। গোটা গ্রামে ঘুরে বহুত মিনতি করে এক জন মহিলাকেো কথা বলাতে পারলাম না। কেউ ভোটের নাম শুনলেই দরজা দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, “আমরা মেয়েমানুষ, ও সবের মধ্যে যাই না।” আবার কেউ সাফ জানাচ্ছেন, “আমাদের তো আলাদা কোনও মত নেই। ঘরের লোক যেখানে বলবে, সেখানেই ভোট দেব।” বুঝলাম, এঁদের ভোটাধিকার ও তার প্রভাব এখনও বিপণনযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

ঘরের লোকেরা অবশ্য দিন আনা দিন খাওয়া নিয়েই চিন্তিত বেশি। ভাগচাষি থেকে পুরোহিত, এখনও ততটা ভাবছেন না ভোট নিয়ে। হাওয়া তৃণমূলের দিকেই, এ কথা স্বীকার করে নিয়েও বলছেন, “দেখি কোন পার্টি কী দেয়, সেই বুঝে ভোট দেব।” এ কথায় অবশ্য গৃহিণীরাও সায় দিলেন। শহর থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বে যে ভাবে বেঁচে রয়েছেন এই সব মানুষজন, তাতে এক হাতা অতিরিক্ত ভাতেরও এঁদের ভোট পাল্টে যেতে পারে। হয়তো অত্যুক্তি মনে হবে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল, মতাদর্শ আসলে এক ধরনের শহুরে বিলাসিতা।

পথেই দেখা এক বাসনবিক্রেতার সঙ্গে, আশপাশের সাত-আটখানা গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাসন ফিরি করা যাঁর কাজ। এঁর গায়ে বহু গ্রামের হাওয়া লাগে। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, আশেপাশের সব গ্রামে চারটে দলই মিছিল করেছে, কথাবার্তা বলেছে মানুষের সঙ্গে। তবে এ অঞ্চলে একটু হলেও বিজেপির একটা উপস্থিতি হয়েছে। বামফ্রন্ট ঘুরে দাঁড়াবে, এমনটা কেউই ভাবছেন না। আর কংগ্রেসকেও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না কেউ। কিন্তু বিজেপি যে ভোট কাটবে, সেটা মনে হচ্ছে। লাল দুর্গ তো বিধানসভায় আপাদমস্তক সবুজ হয়ে গিয়েছিল। এ বার লোকসভার ডাকে তার গায়ে গেরুয়ার ছিটেও লাগবে তা হলে? হাওয়ার কি মতি স্থির নেই? জিজ্ঞেস করতে একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসলে কী জানেন, যারে চোখে দেখি নাই, সে বেশি সুন্দরী!” এ কথা বলার পরই দু’জন খদ্দের জুটে গেল তাঁর। আমি আর অংশুমান অন্য দিকে অন্য দিকে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিলাম, কোন এক অজ পাড়াগাঁ-র কে এক নাম-না-জানা বাসনওয়ালা এক লাইন কবিতায় সাধারণ মানুষের মানসিকতার ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেন! এর জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না!

ফেরার পথে চোখে পড়ল, সার্কাস বসেছে। রীতিমতো বড় তাঁবু ফেলে, বাপ্পি লাহিড়ির বাংলা গান বাজিয়ে চারপাশ জমিয়ে দিয়েছে। এই প্রবল গরমেও টিকিট ঘরের সামনে লাইন নেহাত ফেলনা নয়। একবার ঢুকলাম ভিতরে, যদি ছাই উড়িয়ে কিছু মেলে! সে গুড়ে বালি। কিন্তু আমরা যারা শহরে থাকি আর শীতকাল বিষয়ক লেখায় কমলালেবু বা বড়দিনের সঙ্গে অবধারিত ভাবে সার্কাসকে জুড়ে দিই, তাদের ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ে এক কর্মকর্তা জানালেন, সার্কাস চলে সারা বছরই। শীতকালে তার ব্যবসা হয় শহরে। চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতি, ঘোড়া, জেব্রা আর উট। ‘‘সিংহ নেই?” আপনা থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এল। আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন ভদ্রলোক, সিংহের খেলা দেখানো নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাতে অবশ্য লোক কম হচ্ছে না।

ফেরার পথে পড়ল ভাতার। আধাগঞ্জ, দোকানবাজারে জমজমাট। কমবয়সীদের ভিড়ভাট্টায় ঘুরে বিজেপির আঁচ এখানেও পেলাম। কেউ কেউ নির্বাচনে নিরুৎসাহী বটে, কিন্তু ভোট দেবেন। এক জুতোর দোকানদার অবশ্য বললেন, “ভারতবর্ষের অবস্থা এখন দুর্বিষহ। বিজেপির এলেও সরকার গড়তে হিমশিম খেতে হবে।” হাওয়া যে আসলে ঠিক কোন দিকে, সেটা বোঝা ভার।

শহরে যখন ঢুকলাম আবার, সন্ধে নামছে। বাজার সরগরম। কিন্তু ভোট নিয়ে কথাই বলতে চাইছেন না কেউ। সিধে এড়িয়ে যাচ্ছেন। যেন রীতিমতো অস্পৃশ্য বিষয়। এক তরুণী শিক্ষিকা অবশ্য বললেন, তাঁদের স্টাফরুমে অনেকেই প্রকাশ্যে বলছেন, হিন্দুত্বের খাতিরেই বিজেপির আসা উচিত এ বার। লাল আঁচল না হয় না-ই রইল, কিন্তু সবুজ জমির শাড়িতে গেরুয়া পাড়ও যদি বসে যায়, পশ্চিমবঙ্গের রূপ কতটা খুলবে, তাই ভাবছি।

এটা বর্ধমানের গল্প নয়, দিল্লির গল্প নয়, মহাকরণের গল্প নয়, লোকসভার গল্পও নয়। এটা তো ভারতবর্ষের গল্প। এটা তো শেষ হতে না চাওয়া একটা মেগা সিরিয়াল, যাকে আঞ্চলিকতার এপিসোডে ভাগ করে নিয়েছি আমরা। হাওয়া যার পালেই লাগুক, শেষমেশ ঘটনাবলি কোন দিকে যাবে, সেটা ভেবেই চিন্তা হয়। আমি সত্যিই এই রকম আশা করে যাইনি। কিন্তু ঠিক কী আশা করে গিয়েছিলাম, তাও কি বলতে পারব?

ছোটবেলা থেকেই আমার মনে হতো, অশোকস্তম্ভের পিছন দিকে থাকা চতুর্থ সিংহটা আসলে কোথায়? সে তো কোনও দিন এতটুকু প্রচার পায়নি, কোনও ছবিতে তার মুখ দেখা যায়নি এত বছরের ইতিহাসে। সে কি তবে অভিমানে অশোকস্তম্ভ থেকে নেমে এসে সার্কাস জয়েন করল? খেলা দেখাতে দেখাতে বয়স হয়ে গেল তার?

আর এখন? যখন সার্কাসেও সিংহের খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সে কি অভিমান ভুলে ফেরত যাবে অশোকস্তম্ভে? কারণ আরও বড় একটা সার্কাসের তাঁবু পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল। টিকিটের বদলে ব্যালটে ছাপ্পা দিয়ে মানুষজন এ বার পরের শো দেখতে ঢুকছেন। এই আশায়, যদি আর একটু ভাল কিছু দেখা যায়! এই আর একটু ভালর জন্যই একটা জ্যান্ত সিংহ দরকার ছিল আমাদের। অশোকস্তম্ভের বাকি তিনটে সিংহ তো পাথর হয়েই থেকে গেল। এই ফাটকাবাজির দেশে ওরা আর কোনও খেলা দেখাতে পারবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন