আক্রান্ত সিপিএম নেতা, শেষ দফা নির্বাচনের আগে তুঙ্গে উত্তেজনা

শেষ দফা ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা বেড়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে টহলদারিও। কিন্তু রাজ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভোটপর্বের ৪৮ ঘণ্টা আগে রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং কমিশনের উপরে আক্রমণের ঘটনাও বাড়তে শুরু করেছে। এ দিন দুপুরে বহরমপুরে আক্রান্ত হন পুলিশ পর্যবেক্ষক। সন্ধ্যায় বেলঘরিয়ায় সিপিএমের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চলে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০২:৫৮
Share:

এক দিকে শুরু কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল। অন্য দিকে গোলমালও। শনিবার দক্ষিণ কলকাতায় এই টহলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়ায় আক্রান্ত হলেন সিপিএম রাজ্য কমিটির সদস্য সায়নদীপ মিত্র (ডান দিকে)। রাতে তাঁকে দেখতে যান দমদম কেন্দ্রের প্রার্থী অসীম দাশগুপ্ত। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও এবিপি আনন্দের সৌজন্যে।

শেষ দফা ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা বেড়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে টহলদারিও। কিন্তু রাজ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভোটপর্বের ৪৮ ঘণ্টা আগে রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং কমিশনের উপরে আক্রমণের ঘটনাও বাড়তে শুরু করেছে। এ দিন দুপুরে বহরমপুরে আক্রান্ত হন পুলিশ পর্যবেক্ষক। সন্ধ্যায় বেলঘরিয়ায় সিপিএমের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চলে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি দলের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সভাপতি সায়নদীপ মিত্র। জখম হয়েছেন আরও তিন সিপিএম নেতা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকেও বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের মারধর বা হুমকির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল শাসক দল তৃণমূলের দিকে।

Advertisement

এর পরেই প্রশ্ন উঠেছে, এই পর্বে সুষ্ঠু ভাবে ভোটগ্রহণ ও নিরাপত্তার জন্য নির্বাচন কমিশন যে সব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা যথেষ্ট তো?

এই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ রয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কারণ, এই পর্বে শুধু যে সর্বাধিক ১৭টি আসনে ভোট হচ্ছে, তা-ই নয়, প্রায় সব ক’টি কেন্দ্রেই রাজনৈতিক ভাবে উত্তেজনাপ্রবণ বুথের সংখ্যা বহু। কমিশন যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে আজ, রবিবারে গোলমাল আরও বাড়বে এবং ভোটের দিন তা বড় আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকেরই। প্রধান বিরোধী দল সিপিএম-ও বেলঘরিয়ার ঘটনার পরে প্রশাসনের উপরে পাল্টা চাপ দিতে বড় আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে।

Advertisement

বেলঘরিয়ায় কী ঘটেছিল?

সিপিএম নেতৃত্বের অভিযোগ, শনিবার সন্ধ্যায় বেলঘরিয়ার দক্ষিণপাড়ার ভগবতী চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দলীয় কার্যালয়ের সামনে পতাকা লাগানোর সময়ে আচমকা হানা দেন তৃণমূল কর্মীরা। তাঁরা সিপিএম অফিসে ঢুকে নির্বিচারে ভাঙচুর চালান। থানায় এই ঘটনার অভিযোগ জানাতে যাওয়ার সময়েই সিপিএম কর্মীদের ফের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। তখনই আহত হন সায়নদীপ। জখম হন লোকাল কমিটির সদস্য সুবিমল চক্রবর্তী ও ঝন্টু মজুমদার এবং সুদীপ্ত ঘোষ নামে এক যুব নেতাও। স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীরা জানান, মারের চোটে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান সায়নদীপ। পরে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। তাঁর মাথায় চারটে সেলাই পড়েছে। রাতে তাঁর মাথায় স্ক্যান করানো হয়। সুবিমলবাবুর একটি চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


মোটরবাইক মিছিলের প্রতিবাদে পর্যবেক্ষকদের ঘিরে কংগ্রেস সমর্থকদের বিক্ষোভ। —নিজস্ব চিত্র

রাতে আহত নেতা-কর্মীদের দেখতে হাসপাতালে যান দমদম কেন্দ্রের প্রার্থী তথা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মানস মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তন্ময় ভট্টাচার্যের মতো দলীয় নেতারাও। তৃণমূলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন বাম নেতৃত্ব। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু-সহ বাম নেতারা আজ, রবিবার আহত নেতা-কর্মীদের দেখতে হাসপাতালে যাবেন। বিমানবাবু বলেন, “এটা বর্বরোচিত ঘটনা।” পুলিশ-নির্বাচন কমিশন কী করছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেবের বক্তব্য, “রবিবার সকাল ৯টার মধ্যে অভিযুক্তেরা ধরা না পড়লে হাজার হাজার লোক বি টি রোড অবরোধ করবে।” তন্ময়বাবুর অভিযোগ, দমদম কেন্দ্রের তৃণমূলের প্রার্থী সৌগত রায় কিছু দিন আগে এখানে এসে নানা প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন। তার পর থেকেই তৃণমূলের বাইকবাহিনী এলাকায় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছিল। তিনি বলেন, “এ দিন প্রচার শেষ হওয়া মাত্র তারা হামলা করে।”

দলীয় কর্মীরা হামলা চালিয়েছে, এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন সৌগতবাবু। তিনি বলেন, ওই এলাকার তৃণমূল কর্মী রাবণ চক্রবর্তীকে চড়থাপ্পড় মারেন সিপিএমের কর্মীরা। এর পরে শতাধিক সিপিএম কর্মী তৃণমূলের কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা করে। তখন তৃণমূল কর্মীরা বাধা দিলে দু’-এক জন সিপিএম সমর্থকের সামান্য আঘাত লাগে। “এটা ছোট ঘটনা। সিপিএম বড় করে দেখাচ্ছে,” মন্তব্য সৌগতবাবুর। দলীয় নেতা-কর্মীরা এই ঘটনায় জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল জেলা সভাপতি নির্মল ঘোষও।

পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পরেই এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে র্যাফ মোতায়েন করা হয়। রাতেই বেলঘরিয়ার ওই বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে সায়নদীপ ও সুবিমলবাবুর জবানবন্দি নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে রাত পর্যন্ত এই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতারের খবর মেলেনি।

বেলঘরিয়ার ঘটনার আগে রাজ্যরাজনীতি সরগরম ছিল বহরমপুর নিয়ে। সেখানে তৃণমূলের একটি মোটরবাইক মিছিল সম্পর্কে আপত্তি তোলেন নির্বাচন কমিশনের অন্যতম পুলিশ পর্যবেক্ষক কুমার ইন্দুভূষণ। এর জেরে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে হেনস্থা করে বলে অভিযোগ করেছেন ওই পর্যবেক্ষক। পুলিশ সূত্রের খবর, অতিরিক্ত মোটরবাইক ব্যবহার করে মিছিল করায় বহরমপুরের তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন-সহ ২০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

বস্তুত, শুক্রবার রাত থেকেই বহরমপুর উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। শুক্রবার রাতে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরে উত্তেজনা ছড়ায় বহরমপুরের গির্জাপাড়ায়। তৃণমূলের লোকজন কংগ্রেস কর্মী মিঠুন মৈত্রকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছে বলে অভিযোগ তুলে শনিবার সকালে তাঁর বাড়ি যান মুর্শিদাবাদের জেলা কংগ্রেস সভাপতি অশোক দাস। তখন বহরমপুর শহর তৃণমূলের সভাপতি কানাই রায় ও তাঁর দলবল ফের কংগ্রেসের উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। প্রহৃত ওই কংগ্রেস কর্মীকে এ দিন মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তার পরে এ দিন পুলিশ পর্যবেক্ষকের হেনস্থা হওয়ার ঘটনা। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ বলেছেন, “টিভিতে দেখেছি। রিটার্নিং অফিসারকে বলা হয়েছে। কাল তিনি রিপোর্ট দেবেন।” সিপিএম নেতা সায়নদীপের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়েও তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ এই প্রশ্নের জবাবে সুধীরকুমার জানান, এই ব্যাপারে কিছু তাঁর জানা নেই। এর আগে সুধীর জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল শুরু হয়ে গিয়েছে। এর পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না এলে তাঁদের কিছু করণীয় নেই। কিন্তু পুলিশ পর্যবেক্ষক হেনস্থা হওয়ার পরে প্রশ্ন উঠেছে, কমিশনের লোকেরই যদি নিরাপত্তা না থাকে, ভোটারদের কী হবে? বেলঘরিয়ার ঘটনার পরে সেই প্রশ্ন জোরদার হয়েছে।

এর আগে কমিশনের দফতরে বসে সুধীরকুমার অবশ্য জানিয়েছেন, পঞ্চম দফার ভোটে কী ভাবে নজরদারি করবেন তাঁরা। প্রথম তিন দফার ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল। চতুর্থ দফাতেও সেই অভিযোগ পুরোপুরি থেমে যায়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুধীরকুমার এ দিন জানিয়ে দেন, কোন এলাকায়, কোন পথে দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দিচ্ছে, এ বার তার লগবুক রাখা হচ্ছে। ভিডিও ক্যামেরায় টহলদারির ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। সুধীরকুমার বলেন, “যদি কোনও রাজনৈতিক দল জানতে চায় বা কোনও প্রার্থী যদি অভিযোগ করেন, তাঁর এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী টহল দেয়নি, সে ক্ষেত্রে ভিডিও ক্যামেরায় তোলা ছবি তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হবে।”

কিন্তু শেষ দফা ভোটের আগে যে রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা শুরু হয়েছে, তা কী ভাবে সামলাবে কমিশন? শুধু বেলঘরিয়া বা বহমরপুরের ঘটনাই নয়, শনিবার প্রচারের শেষ দিনে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর কেন্দ্রের জগদ্দলে বিজেপির মিছিল লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। সেখানে এবং ব্যারাকপুরে বাইক-বাহিনীর তাণ্ডবের অভিযোগও ওঠে। সব ক্ষেত্রেই তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব এ দিনই অভিযোগ করেন, শাসন-সহ কয়েকটি এলাকায় সন্ত্রাসের জন্য বামেরা এজেন্ট দিতে পারছেন না। তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আবার ‘নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে’ দাবি করে পাল্টা অভিযোগ করেন, “শাসনের মজিদ মাস্টার তাঁকে খুন করার জন্য বাংলাদেশ থেকে তিন দুষ্কৃতীকে এনেছে।” জ্যোতিপ্রিয়বাবুর অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী। এরই মধ্যে সন্দেশখালির সরবেড়িয়া, ঝুপখালি, বেড়মজুর, ঝুপখালি, শাসন, হাড়োয়ার আমতা-খাটরা, হাসনাবাদের ভবানীপুর-সহ বসিরহাটের বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া এবং প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতেও অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। গৌতমবাবু অবশ্য অভিযোগ করেই থামেননি। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, উত্তর ২৪ পরগনায় রিগিং করার চেষ্টা হলে বাম কর্মীরা এমন পদক্ষেপ করবেন, যাতে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন