দীপকে বোনের আদর। কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: শৌভিক দে।
১২০ দিন জঙ্গি কবলে থাকার পরে ঘরে ফিরছে ছেলেটা। গ্রামের বাড়িতেই ফিরবে। তার আগে কলকাতা বিমানবন্দরেই উঠে এল সেই ‘গ্রাম’। বাঁকুড়ার ইন্দাস থানার দিবাকরবাটির মানুষজন সোমবার তাকে বরণ করে নিয়ে গেলেন গ্রামে।
হাতে একটা সন্দেশের প্যাকেট নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরের চত্বরে ছোটাছুটি করছিলেন দীপ মণ্ডলের বোন মধুমন্তী আর তাঁর বন্ধুরা। আর দীপের বাবা নিখিল মণ্ডল ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩-এ গেটের সামনে।
প্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। তবু বললেন, “মনে হচ্ছে এক-একটা ঘণ্টা যেন এক-একটা দিন। কখন যে ছেলেকে দেখব!”
দুপুর তিনটে নাগাদই বাস বোঝাই করে দীপের প্রতিবেশীরা ইন্দাস থেকে চলে আসেন বিমানবন্দরে। এত দিন দীপের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে সামিল হওয়া তাঁর বন্ধু মানস রায়, বিশ্বরূপ ভট্টাচার্য, সুদীপ্ত চক্রবর্তী, সৌরভ সরকারদের উচ্ছ্বাস যেন ভেঙে পড়ছিল, “আমাদের আর মন মানছিল না। কত দিন দেখিনি দীপকে। তাই ওকে নিয়েই গ্রামে ফিরব বলে চাঁদা তুলে বাস ভাড়া করে চলে এসেছি।”
একশোরও বেশি মানুষ তখন এয়ারপোর্টের বাইরে হুল্লোড়ে মেতে উঠেছেন। এক গ্রামবাসী জানালেন, ইন্দাসের দিবাকরবাটি এলাকায় দীপের বাড়ি থেকে মূল রাস্তার মোড় পর্যন্ত গোটা পথ ফুল-মালায় মুড়ে ফেলা হয়েছে। রাস্তার দু’দিকে লাগানো হয়েছে আলো। আলোর রোশনাইয়ে দীপের বাড়িতে এ দিন যেন অকাল দেওয়ালি।
বিমান আসতে দেরি করছে, কিন্তু আসছে। আসছেন দীপ। কিন্তু তর আর সয় না। দীপ নামার আগেই আবির খেলায় মেতে উঠলেন দীপের বন্ধু-স্বজনরা।
দীপের এক মামা, অশোক মণ্ডল আবির খেলতে খেলতেই জানালেন, “এ বার দোলে আমরা আবির খেলিনি। ২৩ তারিখ দীপের মুক্তির খবর শোনার পরই আমাদের গ্রাম আবির খেলায় মেতে উঠেছিল। আজ আর এক বার খেলছি।”
শুধু আবির খেলা নয়, গত কয়েক মাসে ওই গ্রামের মানুষরা কোনও উৎসবেই অংশ নেননি।
ঢোল বাজছে, কাঁসি বাজছে, চলছে আবির খেলা। শ’খানেক মানুষের এই বাধনভাঙা আনন্দ দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন দেশি-বিদেশি বিমানযাত্রীরাও। প্রশ্ন কী হয়েছে? কোনও ফিল্ম স্টার আসছেন? নাকি কোনও ক্রিকেটার? প্রশ্নকর্তাদের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের মানুষরা। ফিরছে তাঁদের ঘরের ছেলে।
কিন্তু কখন দীপ বিমান থেকে নেমে বাইরে আসবেন?
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও এ-১৭১৩ বিমানের কোনও খবর নেই। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার মতো অবস্থা গ্রামবাসীদের। এর মধ্যেই দীপের বোন মধুমন্তী জানিয়ে রাখেন, “দাদার প্রিয় পায়েস আর শুক্তো। দু’টোই করা হয়েছে বাড়িতে। দাদার প্রিয় নারকেল নাড়ুও করা হয়েছে। শুনছি তো, দাদাকে এত দিন ঘাসপাতার তরকারি খেতে হয়েছে।” শেষ পর্যন্ত দীপের বিমান নামে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তবে ‘ভিভিআইপি’ যাত্রীটিকে উপযুক্ত নিরাপত্তায় বাইরে নিয়ে আসতে আসতে প্রায় পৌনে সাতটা বেজে যায়। দীপ বেরোন ওয়ান-এ গেট দিয়ে।
বাইরেই অপক্ষা করছিল ইন্দাস থেকে আসা ফুলের মালা দিয়ে সাজানো বাস। বন্ধুদের কাঁধে চড়েই বাসে উঠলেন দীপ। ভিড় ঠাসা বাসে বসে কোনও রকমে বলেন, “কোনও দিন যে ফিরতে পারব ভাবতেই পারিনি। আমি মিজোরাম সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখন বন্ধুদের সঙ্গে শুধু দোল খেলব।” বাসের মধ্যে ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে দোল। বাস রওনা দিয়েছে দিবাকরবাটির দিকে। গ্রামের বাড়ির হেঁসেল-ঘরে ব্যস্ত মা অঞ্জনা দেবী খবরটা পেয়ে বলে উঠলেন “দুর্গা, দুর্গা!”