আমার নাটক আর নয়, ব্রাত্যর নোটিস দেবেশকে

স্বজন-বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। এ বার এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে আইনি নোটিসও ধরালেন! গত বুধবার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে আইনি চিঠি পাঠিয়েছেন ব্রাত্য বসু। তাতে বলা হয়েছে, ব্রাত্যর লেখা ‘জতুগৃহ’ নাটকটি দেবেশ আর মঞ্চস্থ করতে পারবেন না। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি নাটকটি প্রথম বার মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। শেষ লগ্নে শো বাতিল করাটা মুশকিল বলে জানান দেবেশ। আইনজীবীর অফিসে বসেই তখন ঠিক করা হয়েছে, একটিই শো করার অনুমতি দেবেন ব্রাত্য। এর পর নাটকটি দেবেশের পরিচালনায় আর মঞ্চস্থ হবে না।

Advertisement

প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১২
Share:

স্বজন-বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। এ বার এক বন্ধু আর এক বন্ধুকে আইনি নোটিসও ধরালেন!

Advertisement

গত বুধবার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে আইনি চিঠি পাঠিয়েছেন ব্রাত্য বসু। তাতে বলা হয়েছে, ব্রাত্যর লেখা ‘জতুগৃহ’ নাটকটি দেবেশ আর মঞ্চস্থ করতে পারবেন না।

আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি নাটকটি প্রথম বার মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। শেষ লগ্নে শো বাতিল করাটা মুশকিল বলে জানান দেবেশ। আইনজীবীর অফিসে বসেই তখন ঠিক করা হয়েছে, একটিই শো করার অনুমতি দেবেন ব্রাত্য। এর পর নাটকটি দেবেশের পরিচালনায় আর মঞ্চস্থ হবে না।

Advertisement

শুধু ‘জতুগৃহ’ নয়, ব্রাত্যর লেখা আরও চারটি নাটক বর্তমানে দেবেশের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে। ব্রাত্যর অনুমতি না নিয়ে সেগুলিও আর মঞ্চস্থ করা যাবে না বলে সাব্যস্ত হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ অভিনয় হতে চলেছে ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ এবং ‘বিকেলে ভোরের সর্ষেফুল’-এর।

কী ভাবে ঘটে গেল এত কিছু? দেবেশের বক্তব্য, বুধবার নোটিস পাওয়ার পরেই তিনি ব্রাত্যকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু দেবেশের দাবি, ব্রাত্য তাঁর সঙ্গে মৌখিক কথাবার্তায় যেতে চাননি। ঠিক হয়, একটি নামী সলিসিটর ফার্মের অফিসে দু’জনের দেখা হবে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে দেবেশ পৌঁছে যান ব্রাত্যর আইনজীবীর অফিসে। দেবেশ সেখানেই বলেন যে, ‘জতুগৃহ’র প্রিমিয়ার শো ৭ ফেব্রুয়ারি। এক সপ্তাহ আগে সেই শো বাতিল করা মুশকিল। বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে হলভাড়া, সব প্রস্তুতিই নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তখন ঠিক হয়, শুধুমাত্র একটা শো করার অনুমতি দেবেন ব্রাত্য। একটা ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ সই করেন দু’জনে। যেখানে স্পষ্ট লেখা হয় দু’জনের সম্মতি নিয়েই এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অনুমতি ছাড়া ব্রাত্যর লেখা নাটক আর কোনও দিনই দেবেশ মঞ্চস্থ করতে পারবেন না।

এ ঘটনায় দেবেশের প্রতিক্রিয়া কী? তাঁর বক্তব্য, ‘‘জানি না আপনারা এ খবর কোথা থেকে পেলেন! আমি এই নিয়ে মিডিয়াতে কোনও আলোচনাই চাইনি।” কিন্তু খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরে তিনি কী বলবেন? দেবেশ বলেন, “আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নাটক মঞ্চস্থ করার লিখিত অনুমতি আমার কাছে আছে কি না। নাটক করতে এসে এ রকম কোনও নথি আমরা সই করি না। তবে ও যখন আইনি চিঠি পাঠিয়েছে, তখন নাটককার হিসেবে আমি ব্রাত্যর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছি।’’

কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য? দেবেশ নাট্যস্বজন থেকে ইস্তফা দিলেন বলেই কি? উত্তরে ব্রাত্য সংক্ষিপ্ত ভাবে জানান, ‘‘আমি নাট্যকার হিসেবে পরিচালক দেবেশকে ‘জতুগৃহ’র অনুমতি বিষয়ক একটা আইনি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সেটা পাওয়ার পর দেবেশ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি ওকে প্রয়োজনীয় অনুমতি দিয়েছি। আমরা দু’জন এখন সহমত।’’ এই আইনি কচকচি কি বাংলা নাটকের সঙ্কট বাড়াবে না? ব্রাত্যর দাবি, “এর সঙ্গে বাংলা থিয়েটারের গুণাগুণের কোনও সম্পর্ক নেই।”

নাট্যমহলের বড় অংশই কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ বলে মনে করছেন না। তাঁদের মতে, নাট্যস্বজন থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর্বে দেবেশ প্রথমে ব্রাত্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে খুব বেশি কিছু বলতে চাননি ঠিকই। কিন্তু মণীশ মিত্র, অর্পিতা ঘোষ এবং দেবেশের বক্তব্য পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যায়, তাঁদের অসন্তোষ ব্রাত্যকে ঘিরেই। উল্টো দিকে ব্রাত্যও প্রকাশ্যে কারও বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। বরং বন্ধুদের বিরুদ্ধে তোপ দাগা তাঁর সহবত-বিরুদ্ধ বলেই দাবি করেছেন। কিন্তু নাট্যকর্মীদের ওই অংশের মতে, এর মানে এই নয় যে, ব্রাত্য গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ নন। দেবেশকে আইনি চিঠি তারই বহিঃপ্রকাশ। আপাতত এই ভাবেই দু’জনের বিচ্ছেদ হয়ে থাকল।

ব্রাত্যর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, সংবাদমাধ্যমে ব্রাত্যর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন দেবেশ। তার পরে ব্রাত্যরই লেখা নাটক মঞ্চস্থ করাকে দ্বিচারিতা বলেই মনে করছেন ওঁরা। তাঁদের দাবি, ব্রাত্য যা করেছেন, নাট্যকার হিসেবে নিজের অধিকার রক্ষার জন্যই করেছেন। তাঁর লেখা এমন কোনও নাটক তিনি মঞ্চস্থ করতে দিতে চান না, যার মহড়া তিনি দেখেননি। এ প্রসঙ্গে দেবেশ বলেন, ‘‘আমি এর আগে কোনও দিনই কোনও রিহার্সাল দেখিয়ে ব্রাত্যর অনুমতি চাইনি। আমি কোনও দিনই চিঠি দিয়ে ব্রাত্যর অনুমতি চেয়ে ওর নাটক মঞ্চস্থ করব না।’’ ব্রাত্য-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দেবেশ সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলে বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেছেন। তার পরে আর একত্রে নাটক করার প্রশ্ন ওঠে না। দেবেশের পাল্টা বক্তব্য, “বিশ্বাস অনেক দিনই ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সঙ্গে সৃজনশীলতাকে গুলিয়ে ফেলতে চাইনি বলেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।” এত দিনে তার আইনি ইতি ঘটল।

ব্রাত্য-দেবেশের মধ্যে আইনি পত্রাঘাত অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকটি ঘিরেও এক বার এমন ঘটেছিল। পরে অবশ্য সমস্যা মিটে যায়। দেবেশকে তাই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ দিন বলেন, ‘‘ওই ঘটনা নিয়ে আমি আর কিছুই বলতে চাই না।’’

কিন্তু শুধু তো দেবেশ নন, নাট্যস্বজনকে ঘিরে সাংসদ-নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষও মুখ খুলেছিলেন ব্রাত্যর বিরুদ্ধে। তিনিও ব্রাত্যর লেখা নাটক মঞ্চস্থ করে থাকেন। তার একটিতে ব্রাত্যর স্ত্রী অভিনয়ও করেন। তা হলে অর্পিতার বেলায় কোনও আইনি চিঠি নেই কেন? ব্রাত্য জানাচ্ছেন, স্বজন-বিচ্ছেদের পরে অর্পিতা আলাদা করে ব্রাত্যর অনুমতি চেয়েছিলেন নাটক মঞ্চস্থ করার আগে। অর্পিতাও স্বীকার করছেন সেটা। দেবেশকে আইনি নোটিস পাঠানোর ঘটনাটা তাঁর মতে ‘দুর্ভাগ্যজনক’। নাট্যমহলের তরফে অবশ্য আর একটা কথাও বলা হচ্ছে। কারও কারও মতে, ব্রাত্য-অর্পিতা একই রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী। ফলে সে দিক থেকেও অর্পিতাকে আইনি চিঠি পাঠানোটা সমস্যাজনক হতো ব্রাত্যর পক্ষে। অর্পিতা নিজে কি এই ব্যাখ্যা মানেন? তাঁর উত্তর, “হতেও পারে, নাও হতে পারে।”

আপাতত নাটক তো বন্ধ হল, কিন্তু দেবেশের সিনেমা? তাঁর পরিচালনায় ‘নাটকের মতো’ ছবিতে তো অভিনয় করেছেন ব্রাত্য! তার কী হবে? ‘‘প্রয়োজন হলে আমি ওটার প্রমোশন করব,’’ বলছেন ব্রাত্য।

দেবেশ আবার গোটা পর্বটাই একটু অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, রাজহংসের মতো দুধ-মেশানো জল থেকে শুধু দুধটা ছেঁকে নিতে হবে। আমাদের রাজহংস হওয়া ছাড়া উপায় নেই।’’

কোনটা দুধ আর কোনটা জল সেটাই শুধু প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন