আমায় সারিয়ে তুলুন, সিবিআই-টা ঘুরে আসি

সরকারি হোক বা বেসরকারি, অনন্তকাল হাসপাতালে শুয়ে থেকে তিনি যে পার পাবেন না, ক্রমশ বুঝছেন মদন মিত্র। সিবিআই মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে, মদন নিজে থেকে না বেরোলে তারাই এ বার হাসপাতালে ঢুকে জেরা করবে তাঁকে। দু-এক দিনের মধ্যেই রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীর খাসতালুক এসএসকেএমে তারা হানা দিতে পারে বলে একটি সূত্রের দাবি। আর সে-খবর নাকি মদনের কানেও গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
Share:

এসএসকেএমে মদন মিত্র। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

সরকারি হোক বা বেসরকারি, অনন্তকাল হাসপাতালে শুয়ে থেকে তিনি যে পার পাবেন না, ক্রমশ বুঝছেন মদন মিত্র।

Advertisement

সিবিআই মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে, মদন নিজে থেকে না বেরোলে তারাই এ বার হাসপাতালে ঢুকে জেরা করবে তাঁকে। দু-এক দিনের মধ্যেই রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীর খাসতালুক এসএসকেএমে তারা হানা দিতে পারে বলে একটি সূত্রের দাবি। আর সে-খবর নাকি মদনের কানেও গিয়েছে। তার পর শনিবার তিনি নিজেই এসএসকেএমের চিকিৎসকদের বলেছেন, “সিবিআই-টা এ বার জলদি ঘুরেই আসি। ডাক্তারবাবু, আমায় সারিয়ে তুলুন তো!”

চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, শুক্রবার সন্ধেয় তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর গ্রেফতারির খবর পেয়ে চিকিৎসকদের মদন বলেছিলেন, তাঁর ভয় করছে! মনে হচ্ছে যেন কেউ গলা টিপতে আসছে।

Advertisement

সেই ভয় কি কেটে গেল? তাই কি ‘ঘুরে আসতে’ চাইছেন মদন?

মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ-মহল বলছে, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। এ সুর আত্মবিশ্বাসের নয়, হতাশার। বিশেষত সৃঞ্জয় গ্রেফতার হওয়ার পর যা আরও চেপে বসেছে। এই ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ টালবাহানায় যে খুব বেশি দিন সিবিআইকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয় সেটা মদন বুঝেছেন। তাই শেষমেশ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতেই ডাক্তারদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে।

কিন্তু সমস্যা হল, ডাক্তারবাবুরা কী ‘সারাবেন’? শুক্র ও শনিবার লাগাতার পরীক্ষার পর মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট যা বলছে, তাতে রোগটা ঠিক কোথায়, সেটা নিয়েই তো ধন্দে পড়েছেন তাঁরা!

শরীরে কার্যত কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। রক্তচাপ স্বাভাবিক। এমনকী পিঠের যে টিউমারের চিকিৎসার কথা বলে মদন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেটি নিয়েও ভয়ের কিছু নেই বলে পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে। এই অবস্থায় মন্ত্রীর মেডিক্যাল রিপোর্ট সিবিআই দেখতে চাইলে তা যে সরকারি হাসপাতালের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তির হতে পারে, এ কথা বিলক্ষণ বুঝছেন স্বাস্থ্য কর্তারাই। আর তাই ভিআইপি কেবিনের আয়েসেও মদনের মুখ ব্যাজার!

অথচ এই তিনিই মাত্র ক’দিন আগে মিন্টো পার্কের কাছে বেসরকারি হাসপাতালে শুয়ে সিবিআই-কে প্রায় নেমন্তন্ন করেছিলেন। পরে শোনা যায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনেই তুঙ্গে উঠেছিল মদনের আত্মবিশ্বাস। যদিও পরের দিনই রহস্যজনক ভাবে সেখান থেকে উধাও হয়ে তিনি ভর্তি হন এসএসকেএমে। দলীয় সূত্র বলছে, পরে মমতাই ফোন করে মদনকে বুঝিয়েছিলেন, তিনি চিকিৎসার কথা বলে একনাগাড়ে পড়ে থাকতে চাইলে সিবিআইয়ের সামনে অস্বস্তিতে পড়তে পারেন ‘বন্ধু’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মদনও তাই ভেবেছিলেন, আশ্রয় হিসেবে সরকারি হাসপাতালই নিরাপদ। হয়তো সেখানে আরও বেশিদিন রোগশয্যায় কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

বস্তুত, এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ মদনের অসুস্থতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়েছিলেন। শুক্রবার তাঁর মুখে ‘আমার ভয় করছে’ শুনে চিকিৎসকেরা বেশ বিচলিত হয়েছিলেন। শনিবারও সকাল থেকে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় মদনের। এমআরআই, সিটি স্ক্যান, রুটিন রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ফুসফুসের অবস্থা বুঝতে ‘পালমোনারি ফাংশান টেস্ট’ (পিএফটি), চোখের পরীক্ষা, শিরদাঁড়ার উপর হওয়া ওই টিউমারে ক্যানসারের চিহ্ন রয়েছে কি না বুঝতে এফএনএসই পরীক্ষা কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু একমাত্র রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কিছুটা বেশি ছাড়া গোলমেলে কিছুই মেলেনি।

টিউমারের রিপোর্ট বলছে ‘সাইটোমরফোলজিক্যাল রিপোর্ট সাজেস্টস, লাইপোমা।’ অর্থাৎ এটি সাধারণ টিউমার। এতে ক্যানসারের চিহ্ন নেই। এমনকী যে ফুসফুসের কষ্টের কথা বলে তড়িঘড়ি মন্ত্রীকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এসএসকেএমে এনে বক্ষ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছিল, সেই ফুসফুসেও মারাত্মক কিছু মেলেনি।

ফলে ডাক্তাররা পড়েছেন উভয়-সঙ্কটে। মন্ত্রী বলে কথা! তাই না-পারছেন ফেলতে, না-পারছেন গিলতে। তার উপরে ভিআইপি কেবিন মদনের আস্তানা হওয়ার পর সেখানে যেন মেলা বসেছে। স্ত্রী-পুত্রেরা তো দিনভর রয়েইছেন। উটকো লোকের আনাগোনারও অন্ত নেই। কেউ ভিজিটিং আওয়ার-এর তোয়াক্কা করছেন না। হাসপাতালকর্মীরা বিব্রত হচ্ছেন। কিন্তু সবারই হাত-পা বাঁধা!

এ দিন বিকেলে অধ্যক্ষের ঘরে কিছু ক্ষণ বৈঠক করেন মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা। সিবিআইয়ের অফিসারেরা আচমকা হাসপাতালে এসে মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখতে চাইলে বা কোনও বিশেষজ্ঞকে নিয়ে এসে মদনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে চাইলে তার অনুমতি দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে কথা হয় বৈঠকে।

পরে চিকিৎসক রাজেন্দ্র পাণ্ডে জানান, বৈধ সরকারি কাগজ দেখালে সিবিআইকে রিপোর্ট দেখাবে হাসপাতাল। এর পরেই ডেপুটি সুপার সর্বেশ্বর মণ্ডল-সহ কয়েক জন ডাক্তারকে নিয়ে মদনবাবুকে দেখতে যান অধ্যক্ষ। সূত্রের খবর, তাঁদের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেননি মন্ত্রী। চুপচাপ শুয়ে ছিলেন। তাঁকে যথেষ্ট অবসাদগ্রস্ত মনে হয়েছে চিকিৎসকদেরও। সাংবাদিকেরা তাঁর শরীরের অবস্থা জানতে বাইরে ভিড় করে আছেন, সে কথা মন্ত্রীকে বলা হলে তিনি মাঝপথে চিকিৎসকদের থামিয়ে বলেছেন, “বাদ দিন, ও সব কথা ভাল লাগছে না।”

মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য মদনের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এখনও কিছু বলেননি। নেত্রীর সঙ্গে তাঁর এ দিন কোনও ফোনালাপ হয়েছে বলে মদনও স্বীকার করেননি। তবে মন্ত্রীর আর্জি শোনার পরে ডাক্তারেরা তাঁকে ছাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। সামনের সোম-মঙ্গলবারই এই নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সারদা কেলেঙ্কারির পর থেকে যত বার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের ছায়া তাঁর উপরে পড়েছে, তত বারই কার্যত ‘যঃ পলায়তি, স জীবতি’ পন্থা আঁকড়ে ধরেছেন মদন। হয়তো বুঝেছেনস হাসপাতালের আশ্রয়ই নির্ভরযোগ্য। পুজোর আগে দুই সহচরকে সিবিআই জেরার পর আতঙ্কে ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়েছিল তাঁর। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিবিআইয়ের জেরা মন্ত্রীর জন্য কতটা ‘স্বাস্থ্যকর’ হবে? শুনে এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের জবাব, “মন্ত্রীর শরীরে কিছু অসুবিধে আছে, তবে তিনি কথাবার্তা সবই বলতে পারছেন। সিবিআই চাইলে কথা বলতেই পারেন।”

এসএসকেএম সূত্রের খবর, আর কিছু না হোক, সৃঞ্জয়ের গ্রেফতারির পর আতঙ্ক আবার গ্রাস করছে মদনকে। শরীর তাঁর তেমন দুর্বল নয়, গোটাটাই টেনশন। শুক্রবারের পর এ দিনও রাতের খাবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। দু’দিনেই যেন অনেকটা বুড়োটে লাগছে রীতিমতো শৌখিন এই তৃণমূল নেতাকে। পোড়খাওয়া নেতা সম্ভবত দেওয়ালের লেখা পড়তে পারছেন। পিজিতেও বেশি দিন থাকা যাবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন