এ কোন বাংলা, বিস্ময় জাগাচ্ছে উৎসব সংখ্যা

শিল্প নেই। শুধু তোলাবাজির দাপট। শিক্ষায় নৈরাজ্য। আইন-শৃঙ্খলা শিকেয়। নানা সমস্যায় ডামাডোল রাজ্য জুড়ে! শাসক দলের মুখপত্রের উৎসব সংখ্যা দেখলে মনে হবে, এ কোন পশ্চিমবঙ্গ! তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের কলমে শিক্ষা, শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে ছবি ফুটে উঠেছে, বাস্তবের সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক।

Advertisement

সঞ্জয় সিংহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

শিল্প নেই। শুধু তোলাবাজির দাপট। শিক্ষায় নৈরাজ্য। আইন-শৃঙ্খলা শিকেয়। নানা সমস্যায় ডামাডোল রাজ্য জুড়ে!

Advertisement

শাসক দলের মুখপত্রের উৎসব সংখ্যা দেখলে মনে হবে, এ কোন পশ্চিমবঙ্গ! তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের কলমে শিক্ষা, শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে ছবি ফুটে উঠেছে, বাস্তবের সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক। এক দিকে লাগামহীন সব দাবি কল্পনাকেই বাস্তব বলে দেখাতে চেয়েছে। বাকিটা বিনোদন! কোথাও কোথাও উদ্ভট রসের বিনোদনও বটে!

তাঁর সাড়ে তিন বছরের রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গকে মেলা আর উৎসবে যেমন মাতিয়ে রাখতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর দলের মুখপত্রের উৎসব সংখ্যাতেও তেমনই আনন্দ-কলরব তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি এবং তাঁর মন্ত্রীরা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজের লেখায় ফের দাবি করেছেন, ‘ধ্বংসস্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে ইমারত গড়ার কাজটা শুরু করতে হয়েছে’ তাঁকে। কিন্তু এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা তাঁর সেই কাজের মর্যাদা দিচ্ছে না। কুৎসার ঝড় বিদেশেও পৌঁছেছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ। তাই মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, তাঁর সিঙ্গাপুর সফরে শিল্পপতি, অফিসার ও বাংলার ‘প্রকৃত সাংবাদিকদের’ একত্রে নিয়ে গিয়ে প্রবাসীদের কাছে ‘প্রকৃত সত্য ও সঠিক তথ্য’ তিনি তুলে ধরেছেন। কারণ তাঁর কথায়, ‘বাংলা মা-কে বিশ্বের দরবারে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের স্বপ্ন’। মুখ্যমন্ত্রী এবং দলনেত্রীর সুরেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, শিক্ষায় রাজ্য প্রথম সারিতে উঠে আসছে! রোজ রোজ কলেজে-কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব লঙ্কা-কাণ্ড ঘটে চলেছে, সে সবের ধারপাশ দিয়েও না গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষায় উন্নয়নের ঢাক বাজিয়েছেন! কারিগরি ও জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রেরণায় তাঁর দফতর প্রতি ঘরে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। শিল্প এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র লেখক তালিকায় নেই। কিন্তু পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম রাজ্যের শিল্পায়নের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যেখানে তাঁর দাবি, কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর নেত্রী এক নতুন শিল্পায়ন প্রক্রিয়া চালু করেছেন, যা এর আগে কেউ করেনি! পুরমন্ত্রীর যুক্তি, মুখ্যমন্ত্রীর নয়া নীতির জেরে নির্মাণ শিল্পে বিকাশ ও সমৃদ্ধির বিকাশ হবে। এর ফলে বালি, সিমেন্ট পাথর, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং রঙের ব্যবসার উন্নতি হবে। তবে সাড়ে তিন বছরে নতুন বিনিয়োগ কত হয়েছে বা বড় শিল্প কিছু এসেছে কি না, তার উল্লেখ লেখায় নেই। হয়তো প্রত্যাশিত ভাবেই! যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস দেখান, তাঁর দফতরও প্রচারের ঢাক না বাজিয়ে নিঃশব্দে কেমন উন্নয়নের কাজ করছে। আর জ্যোতি বসু-অশোক ঘোষদের বিখ্যাত উক্তি তুলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের আর্জি, ‘মা-মাটি-মানুষের সরকারকে নিজের চোখের মণির মতো রক্ষা করুন’!

Advertisement

বাস্তব যে আদৌ এমন মসৃণ নয়, তার সামান্য ইঙ্গিত তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর লেখায় ধরা পড়েছে। তবে তিনিও সবিস্তার ব্যাখ্যায় যাননি। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে দেশের সামনে যে বিপদ এসেছে, তা নিয়ে বিশদ আলোচনায় গিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। বিজেপি-র উত্থানকে বিপদ বলে চিহ্নিত করে তার মোকাবিলায় পূর্ণেন্দুবাবু সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত এক চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রীই দিয়েছিলেন।

এই পর্যন্ত একটা ভাগ। বাকিটা অন্য রকম! বেশির ভাগই দেবী-বন্দনার ছলে দিদি-বন্দনা! অন্য দলের, বিশেষত বামপন্থীদের মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থাকে। শাসক দলের উৎসব সংখ্যায় সে সবের চেয়ে বিনোদনমূলক অধ্যায়েরই পাল্লা ভারী। সাংসদ-অভিনেত্রী মুনমুন সেন তাঁর মা প্রয়াত সুচিত্রা সেনকে নিয়ে লিখেছেন। মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা চলচ্চিত্র নিয়েই লিখেছেন। কিন্তু ছাপিয়ে গিয়েছেন অন্যদের! তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, তৃণমূল নেত্রীকে দেখে তিনি কেমন লড়াই করতে শিখেছেন! তিনি যে কতটা সিপিএম-বিরোধী তা বোঝাতেও কসুর করেননি মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র! ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’ ছবির ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’ সংলাপের উল্লেখ করে শ্রীকান্ত বলেছেন, ‘প্রত্যেকটা ছবি সিপিএমের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত রাগ-অভিমান থেকে করেছিলাম’! শ্রীকান্তের মতোই বাম-বিরোধিতায় পিছিয়ে নেই একদা বাম-ঘনিষ্ঠ কবি সুবোধ সরকারও। তাঁর দীর্ঘ কবিতার শেষে তিনি লিখেছেন, ‘নটে গাছটি মুড়োলো।। ফিশ কাটলেট কুড়োলো।। নটে গাছটি মুড়োলো।। আলিমুদ্দিন ফুরোলো।।’

কবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিছিয়ে থাকবেন, তা-ই কখনও হয়? মা-মাটি-মানুষের দলের মুখপত্রের শুরুতেই ‘মাটি’ নিয়ে কবিতায় তৃণমূল নেত্রী লিখেছেন, ‘কেড়েছিস তোরা মায়ের আঁচল/লুটেছিস আমাদের মাটি/ মাটির বিকল্প জননী জন্মভূমি/ হয় না আমের আঁটি।।’ এই পর্বের বেশির ভাগ লেখাই মাতৃভক্তি, নেত্রী ভক্তি, নারী শক্তির প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ের উপর। দলের যুব সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী যেমন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শের ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনই তরুণ সাংসদ তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় দেবী দুর্গার ঐশী আর্বিভাবের প্রকাশ দেখানোর চেষ্টা হয়েছে তাঁর পিসির মধ্যেই! নারী শক্তির বিষয়ে দলের জাতীয় মুখপত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনও তাঁর জীবনে মা-স্ত্রী-কন্যা এবং অবশ্যই দলনেত্রীর প্রভাবের কথা লিখেছেন ইংরেজিতে।

হরেক বিনোদনের প্যাকেজের মধ্যেও শাসক দলের উৎসব সংখ্যায় ব্যতিক্রম পর্যটনমন্ত্রী, নাট্য-ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসুর নাটক ‘জতুগৃহ’। মহাভারতের একটি কাণ্ডের ঘটনা নিয়ে ব্রাত্যের নাটকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মিল কেউ খুঁজে পেতে পারেন। চিরশত্রু পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোর আগে ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন দুর্যোধন, ‘ভুলে যাবেন না, রাষ্ট্রযন্ত্র আজ আমাদের হাতে। এই সম্পূর্ণ যন্ত্র ও পদ্ধতি দিয়ে আমরা প্রথমে ধীরে ধীরে ওদের (পাণ্ডব) অপ্রাসঙ্গিক করে তুলব পিতা। ওরা তাই নীরব হয়ে থাকবে।...আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে পেরেছি জাতি বা মর্যাদার উচ্চ-নীচ হতে পারে, কিন্তু চক্রান্তের কোনও উচ্চ-নীচ হয়না। চক্রান্ত চক্রান্তই। শত্রু শত্রুই।...’

মন্ত্রীরা যদি রাজ্য নিয়ে কল্পনার ছবি আঁকতে পারেন, পাঠকেরই বা কল্পনা করে নিতে দোষ কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন