নবান্নে যখন সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট চলছে, তখন উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর শাখা সচিবালয় উত্তরকন্যায় সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ শুরু করল রাজ্য সরকার। ওই ভবনের বাইরে পুলিশি পাহারা থাকলেও ভিতরের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে একটি বেসরকারি সংস্থা। তারাই বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছে, উত্তরকন্যার যেখানে-সেখানে আর ঘোরাঘুরি করা যাবে না। প্রেস কর্নারেই বসে থাকতে হবে সকলকে।
এই পরিস্থিতিতে বুধবার মহাকরণের সামনে প্রফুল্ল চাকির মূর্তিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের মাল্যদান অনুষ্ঠানও বয়কট করলেন সাংবাদিকেরা। স্বাধীনতা সংগ্রামীর জন্মদিন উপলক্ষে এ দিন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর। পুলিশের অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও মহাকরণের সাংবাদিকেরা সেখানে না গেলে শেষে দু’-এক জন সরকারি অফিসারের উপস্থিতিতে প্রফুল্ল চাকির মূর্তিতে মালা দিয়ে ফিরে যান অমিতবাবু। একই ভাবে নবান্নের প্রেস কর্নারে রাজ্যের পরিকল্পনামন্ত্রী রচপাল সিংহ যখন প্রফুল্ল চাকির ছবিতে যখন মালা দেন, তখনও সেখানে গরহাজির সব সাংবাদিক।
এ দিন দুপুরে বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের এক অনুষ্ঠানেও এই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় অমিতবাবুকে। নবান্নে সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হয়। অনুষ্ঠান তখন শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন শুনে তিনি কোনও কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে যান।
এর পরেই তিনি যান মহাকরণে, প্রফুল্ল চাকির মূর্তিতে মাল্যদান অনুষ্ঠানে। এবং সেখানে গিয়েও বয়কটের মুখে পড়েন। সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, দুপুরের এই অনুষ্ঠানের জন্য অমিতবাবু মহাকরণে আসার আগেই পুলিশ সেখানে হাজির সাংবাদিকদের অনুরোধ করে, তাঁরা যেন মাল্যদান অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন। কিন্তু সাংবাদিকেরা পুলিশকে জানিয়ে দেন, তাঁরা যাবেন না। পুলিশও আর অনুরোধ করেনি।
সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ ও গ্রেফতারির হুঁশিয়ারির প্রতিবাদে গত সোমবার থেকে নবান্নে সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট চলছে। সে দিন বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করতে এলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ওই অনুরোধে কর্ণপাত না করায় ‘ব্রিফিং রুম’ ছেড়ে বেরিয়ে যান সাংবাদিকেরা। প্রায় ফাঁকা ঘরে মিনিট পাঁচেক নিজের বক্তব্য বলে পোডিয়াম ছাড়েন অর্থমন্ত্রী। নবান্নের খবর, নিজের দফতরে ফিরে ফের পুলিশকে এক হাত নেন অর্থমন্ত্রী। প্রশাসনের শীর্ষমহলের কাছে তাঁর অভিযোগ, সংবাদমাধ্যম যে তাঁর ডাকা সাংবাদিক বৈঠক বয়কট করবে তা পুলিশ আগাম জানতে পারেনি। সে জন্যই তাঁকে চূড়ান্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
সেই ‘আগাম খবর’ জানতেই এ দিন নবান্নে সক্রিয় হয়ে ওঠে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের একাংশ। একাধিক সাংবাদিককের কাছে তাঁরা জানতে চান, সে দিন অর্থমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক বয়কটের পরিকল্পনা কি পূর্ব পরিকল্পিত, না আচমকাই সকলে একজোট হয়েছিলেন? গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, যদি মুখ্যমন্ত্রীও প্রেস কর্নারের পোডিয়ামে সাংবাদিক বৈঠক করতে আসেন তা-ও কি বয়কট করবেন সাংবাদিকেরা?
এই প্রশ্নের মধ্যেই বুধবার থেকে উত্তরকন্যায় সাংবাদিকদের গতিনিধি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে দিয়েছে সরকার। এ দিন সকালে ওই সচিবালয়ে উত্তরবঙ্গ উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে সাত জেলার বৈঠকের সময় সাংবাদিকদের ধারেকাছে যেতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের লাউঞ্জ ও করিডর থেকে সরে প্রেস রুমে চলে যেতে বলা হয়। যে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা উত্তরকন্যার ভিতরের নিরাপত্তা দায়িত্বে রয়েছে তার লোকজন জানান, “উপর থেকে নির্দেশ রয়েছে। এর বেশি বলা যাবে না।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তাঁর জানা নেই বলে দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “উত্তরকন্যা মুখ্যমন্ত্রীর শাখা সচিবালয়। আমার দফতর নয়। তাই কিছু বলতে পারব না।” ওই ভবনের নোডাল অফিসার শুভাশিস ঘোষও এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন। আর উত্তরকন্যার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম-সচিব তাশি শেরপার দাবি, “কই এমন তো কিছু জানি না।” এর পরে সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর সংযোজন, “প্রেস রুমটা ভালই। সেখানেই সব সাংবাদিক সম্মেলন হয়। অনেকের বসারও ব্যবস্থা রয়েছে।”