ফুলবিক্রেতা মা পিঙ্কি রানা ও ছেলে অপূর্ব (বাঁ দিক থেকে)। শংসাপত্র দিচ্ছেন মহম্মদ জাফরুদ্দিন। ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল পুরস্কার’-এর আসরে। —নিজস্ব চিত্র
কে বলবে, দু’জনে দু’জনকে আগে কখনও দেখেনইনি।
বাংলার মফস্সলের লড়াকু কিশোরীকে শংসাপত্র দেওয়ার সময়ে আবেগে হাত কাঁপছিল কাঠমান্ডুবাসী অনুরাধা কৈরালার। সেই অনুরাধা, গত দু’দশকে অন্তত ১২ হাজার নাবালিকার পাচার হওয়া যিনি রুখে দিয়েছেন।
উত্তরপাড়া এলাকার মেয়েটির মা যৌনকর্মী। মদ্যপ বাবা মেয়েকে মায়ের পেশায় নামাতে চেয়েছিল। কিশোরী তবু হার মানেনি। মা-বাবাকে লুকিয়ে কলকাতায় এসে পুরস্কার নিয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী চেঁচিয়ে বলছিল, “ইমানদার পুলিশ অফিসার হতে চাই।”
ক্যানিংয়ের সত্যজিৎকে দলুইকে বুকে টেনে নিলেন শিক্ষাব্রতী ট্যাক্সিচালক গাজি জালালুদ্দিন। ট্যাক্সি চালিয়েই সুন্দরবনে দু-দু’টি অনাথ এতিম স্কুল গড়ে তুলেছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ৪০০ ছুঁয়েছে।
পরিবারকে টানতে সত্যজিৎকেও সকালে খেতমজুর, সন্ধেয় ইটভাটার শ্রমিকের খাটনি খাটতে হয়। কিন্তু তাতেও উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৮% নম্বর পেয়েছেন তিনি। দুই যোদ্ধার সাক্ষাতের মুহূর্তে হাততালিতে ভাসল সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়াম।
শনিবার ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল পুরস্কার’-এর আসরে অসম যুদ্ধজয়ের এমন বহু চিত্রনাট্যের হদিস মিলল। আবহে কখনও ‘একলা চলো রে’, কখনও ‘আই বিলিভ আই ক্যান ফ্লাই’! দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সুকান্ত চৌধুরী বললেন গোটা দেশের ক্ষমতায়নের স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে ছক-ভাঙা কিছু মানুষই ভরসা!
তিন ঘণ্টায় এই ব্যতিক্রমীরাই প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন। যেমন আইআইটি-র ডিগ্রি পেয়েও চাকরির পরোয়া না-করা বিনায়ক লোহিয়া। বনগাঁয় বিনায়কের সংস্থা এখন অজস্র পিছিয়ে-থাকা ছেলেমেয়ের পরিবার। শিলিগুড়ির গৌতম বিশ্বাস ও সমিত বিশ্বাস আবার মাদকাসক্ত কিশোর-তরুণদের জীবনে ফেরাতে মরিয়া।
সঞ্চালক ব্যারি ও’ব্রায়েন বলছিলেন, “রথ চালাতে ঘোড়া হয়তো সহজে জুটবে না। তা বলে রথ টানতে পিছপা হলে চলবে কেন?” হাতে-পায়ে প্রতিবন্ধী নারকেলডাঙার মহম্মদ জাফরুদ্দিনের লড়াই এই সাহসের কথাই বলে গেল। মুখ দিয়ে লিখে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয়েছিলেন। এখন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জাফর খিদিরপুরের এক ফুলওয়ালি মা ও তাঁর মেধাবী ছেলেকে পুরস্কার দিলেন। সেই মা, পিঙ্কি রানার পুত্র অপূর্ব মাধ্যমিকে ৮৪% নম্বর পেয়েছেন।
আজন্ম মৃগীরোগ নিয়েই পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন মনসিজ বন্দ্যোপাধ্যায়। উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষার আগে রোজ ৭-৮ বার খিঁচুনির ধাক্কায় ডান হাতটা গেল অসাড় হয়ে। বাঁ হাতে পরীক্ষা দিলেন মনসিজ! মাধ্যমিকে অঙ্কে ফুল মার্কস পাওয়া ছাত্রকে অঙ্কে ৬১-তেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। কিন্তু স্ট্যাটিসটিক্সে ৯১ সমেত মোট ৭০% নম্বর পেলেন। পড়াশোনা, খেলা, গান, নাটক, আঁকায় তুখোড় পড়ুয়াদের সঙ্গে এই ‘বিশেষ’ কিশোর-তরুণদের নিয়েই তৈরি হল এক অনন্য রংধনু। ডোকরা, ধোকরা (পাটের কাজ), বাঁশের কাজ, শোলার কাজ, মাটির পুতুল গড়ার শিক্ষার্থী-শিল্পী থেকে সেলাই দিদিমণিরাও এক-একটি রং উঠলেন।
‘স্পেশাল চাইল্ড’দের দরদি দিদিমণি, ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের অনুপা দাশগুপ্তকে সারা জীবনের অবদানের পুরস্কার দিলেন প্রবীণ শিক্ষাব্রতী নিল ও’ব্রায়েন। গত চার দশক ধরে পাঠভবনের অঙ্কের শিক্ষক দীপঙ্কর সরকারের সম্মাননার সময়ে প্রাক্তন ছাত্র সন্দীপ রায়, অনীক দত্ত-রা উঠে দাঁড়ালেন। বিড়লা হাই স্কুল ও সুশীলা বিড়লা গার্লস স্কুলের অন্যতম স্থপতি ঋতা বিব্রার জন্যও উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না।
একলা মায়ের সন্তান স্বপ্নিল পরাশর মায়ের কেমো চলছে বলে আসতে পারেননি। অষ্টপ্রহর উৎকণ্ঠার মধ্যেই আইএসসি-তে ৯২% নম্বর পেয়েছেন তিনি। পুণের জার্মান বেকারি বিস্ফোরণে নিহত শিল্পা গোয়েনকার বাবা রাজেশ গোয়েনকা বা শল্যচিকিৎসক অমিতাভ চক্রবর্তীর মতো মঞ্চে অনুপস্থিত কারও কারও নামও উঠে এল। উত্তরণের লড়াইকে দেবদূতের মতোই সাহায্য করে যাচ্ছেন তাঁরা। কিছু সম্বলহীন কৃতী পড়ুয়ার জন্য ল্যাপটপ-ডেস্কটপের সংস্থান হল। দরকার আরও অনেকের। সঞ্চালকদের বার্তা, সেতু বাঁধতে কাঠবেড়ালির সাহায্যও নেহাত কম নয়।
আবেগের চিত্রনাট্য শুধু গলার কাছে দলা পাকানো কষ্ট নয়, আরও কিছু করার কথাই বলে গেল।