টলিউড তারকা দেবকে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮৬০ দিয়েছে একা কেশপুর। বক্স অফিসের পরিসংখ্যান নয়। ভোটবাক্সের পরিসংখ্যান!
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে সদ্য সাংসদ নির্বাচিত হওয়া তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী ওরফে দেব ওই পরিমাণ ‘লিড’ পেয়েছেন শুধু কেশপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে!
সেই কেশপুর, বাম আমলে যেখানে বিরোধীরা বার বার ভোটের নামে প্রহসনের অভিযোগ করতেন। এ বার সেখানে দেবের ব্যবধান নিয়েও একই প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। বর্তমান বিরোধীদের অভিযোগ, বিভিন্ন লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটি বা দু’টি বিধানসভা বেছে নিয়ে সেখানে চুটিয়ে ভোট ‘করেছে’ শাসক দল। ওই লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফলের কাঠামো গড়ে দিয়েছে ওই কয়েকটি বিধানসভার ‘লিড’ই।
কেশপুরে ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে সিপিএমের নন্দরানি দল এক লক্ষ ৮ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন। তার পরে ২০০৪ ও ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন — দু’বারই সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্ত কেশপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে এগিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার দেব কেশপুর থেকে যা ‘লিড’ পেয়েছেন, তা ছাপিয়ে গিয়েছে অতীতের সব রেকর্ডকে! রাজ্যের আর কোনও প্রার্থী একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এত ‘লিড’ পাননি!
সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের বক্তব্য, “তৃণমূলের পক্ষে এই ভোট যে স্বাভাবিক নয়, এটা আবার বলে দিতে হবে নাকি!” কিন্তু প্রায় এই রকম ব্যবধানে তো বামফ্রন্টও কেশপুর থেকে জিতত? দীপকবাবু নিরুত্তর! তৃণমূলের মহাসচিব ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “কেশপুরে ভোট পড়ার ধরনটাই এই রকম। যখন যার পক্ষে যায়, সে দিকে ঢেলে ভোট পড়ে!” পার্থবাবুর এই যুক্তি মানলে বাম জমানার ব্যবধান নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তোলা যায় না!
যদিও প্রশ্ন উঠছে। এবং তা তুলছে বুথওয়াড়ি হিসেব। ঘাটাল কেন্দ্রের কেশপুর, ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের গড়বেতা, আরামবাগের খানাকুল ও চন্দ্রকোনা, বিষ্ণুপুরের কোতুলপুর, বোলপুরের নানুর, লাভপুর, ময়ূরেশ্বর, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট ও বোলপুর, বীরভূমের সাঁইথিয়া, বসিরহাটের হাড়োয়া ও মিনাখাঁ, জয়নগরের ক্যানিং (পূর্ব), মথুরাপুরের মগরাহাট (পশ্চিম), ডায়মন্ড হারবারের বিষ্ণুপুর, তমলুকের নন্দীগ্রাম ও ময়না এবং কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের শীতলখুচি ও নাটাবাড়ির মতো বিধানসভা কেন্দ্রের বুথওয়াড়ি ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক হিসেবেই অন্তত ৭০টি বুথে ৯০% বা তার বেশি ভোট শাসক দলের পক্ষে গিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই হারে ভোট পড়ার বিষয়টিকে সন্দেহজনক হিসেবে গণ্য করে নির্বাচন কমিশন।
তথ্য বলছে, ওই ১২টি লোকসভা কেন্দ্রের ৭০টি বুথের মধ্যে ১২টি বুথে তিন বিরোধী দল— বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেসের মোট প্রাপ্ত ভোট দু’অঙ্কেও পৌঁছয়নি! ওই ১২টির মধ্যে রয়েছে কেশপুরের ৩টি, গড়বেতার ২টি, খানাকুলের একটি, কোতুলপুরের একটি, লাভপুরের একটি, মঙ্গলকোটের একটি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর ও ক্যানিং (পূর্ব)-এর একটি করে এবং তমলুকের ময়নার একটি বুথ।
বাংলার ভোটে এমন ছবি অবশ্য নতুন নয়। অতীতের পাঁশকুড়া তো বটেই, আরামবাগে সিপিএমের অনিল বসু যখন ৫ লক্ষ ৯২ হাজার ভোটে জিতেছিলেন, তখনও বহু বুথে এমন একতরফা ছবি দেখা যেত। চালু তত্ত্ব ছিল, শাসক দলের হয়ে যারা ‘ভোট করে’, ব্যাপারটার বিশ্বাসযোগ্যতা রাখার জন্য তারাই অল্প কিছু ভোট বিরোধীদের বাক্সেও দিয়ে দেয়! এখনকার বিরোধীদের দাবি, এই প্রবণতাই এখন আরও বিস্তৃত হয়েছে।
বিরোধীদের আরও বক্তব্য, স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থনেই রাজ্যের ৩৪টি আসনে জয় পাওয়ার কথা বলছে তৃণমূল। তা হলে আসানসোলে জনসমর্থন না পেয়েই হার হয়েছে বলে তাদের মেনে নেওয়া উচিত। সেই আসনে দলীয় প্রার্থীর হারের জন্য তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী মলয় ঘটককে পদ থেকে সরানো বা বহরমপুরে খারাপ ফলের জন্য আর এক মন্ত্রী সুব্রত সাহাকে তিরস্কারের মানে কি এটাই ঘুরপথে মেনে নেওয়া নয় যে, ভোট আসলে করান নেতারাই? বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “সুষ্ঠু ভাবে ভোট হলে আসানসোলে আমরা দু’লক্ষ ভোটে জিততাম! ওখানে তৃণমূল নেতৃত্ব যতটা চেয়েছিলেন, ততটা রিগিং করতে পারেননি বলেই নেতাকে (মলয়) সরিয়ে দেওয়া হল!”
কেশপুরের ২৬ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৪৯০টি ভোট, বিজেপি ৬টি ও কংগ্রেস ২টি ভোট। বামফ্রন্ট সেখানে একটি ভোটও পায়নি! গড়বেতার ২২৪ নম্বর বুথে তৃণমূল যেখানে ১০০৫টি ভোট পেয়েছে, সেখানে বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেস— এই তিন বিরোধী দলের মোট প্রাপ্ত ভোট ৯! কোতুলপুরের ২০৩ নম্বর বুথে কংগ্রেস একটি ভোটও পায়নি। বামফ্রন্ট দু’টি ও বিজেপি ১টি ভোট পেয়েছে। ওই বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৭৮৯টি ভোট। খানাকুলের ৮৬ নম্বর বুথে বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেস— এই তিন দলের মোট প্রাপ্ত ভোট ৭। অন্য দিকে একা তৃণমূল পেয়েছে ৬০৫!
ঝাড়গ্রামে তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী উমা সরেনকে শুধু গড়বেতাই ‘লিড’ দিয়েছে ৭৭ হাজার ৬৬১ ভোটে! আবার আরামবাগ কেন্দ্রে জয়ী তৃণমূলের আফরিন আলিকে (অপরূপা পোদ্দার) খানাকুল ‘লিড’ দিয়েছে ৭৫ হাজার ৬৬৮ ভোটের! বীরভূম জেলার বোলপুর কেন্দ্রের লাভপুর বিধানসভায় ১১৪ নম্বর বুথে তৃণমূল ৮৮৪টি ভোট, বাম ২টি ও বিজেপি ১টি ভোট পেয়েছে! সেখানে কংগ্রেস ০! বীরভূম কেন্দ্র থেকে ৬৭ হাজারের কিছু বেশি ভোটে জেতা শতাব্দী রায় শুধু সাঁইথিয়া কেন্দ্রেই ৩৩ হাজার ভোটের ‘লিড’ পান। জেলার অন্য লোকসভা কেন্দ্র বোলপুর থেকে ২ লক্ষ ৩৬ হাজারেরও বেশি ভোটে জেতা তৃণমূলের অনুপম হাজরাকে নানুর বিধানসভা একাই ৬২ হাজার ভোটের ‘লিড’ দিয়েছে।
ব্যারাকপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী দীনেশ ত্রিবেদী দু’লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছেন। শুধু বীজপুর বিধানসভা তাঁকে ৭৪ হাজার ৬৩৯ ভোটে ‘লিড’ দিয়েছে। বসিরহাট কেন্দ্রে এক লক্ষ ৯ হাজারের কিছু বেশি ভোটে জেতা তৃণমূলের ইদ্রিশ আলিকে হাড়োয়া ও মিনাখাঁ বিধানসভা কেন্দ্র যথাক্রমে প্রায় ৪৩ হাজার ও ৩৬ হাজার ভোটে এগিয়ে দিয়েছে। হাড়োয়ার ৯৯ নম্বর বুথে তৃণমূল পেয়েছে ৮৫৩ ভোট। সেখানে বামফ্রন্ট ১ বিজেপি ৬ এবং কংগ্রেস ৩টি ভোট পেয়েছে! একই ভাবে মেদিনীপুর আসনে সন্ধ্যা রায়কে প্রায় ৪০ হাজার ‘লিড’ দিয়েছে কেশিয়াড়ি বিধানসভা। কোচবিহারে তৃণমূলের রেণুকা সিংহ শীতলখুচি ও মাথাভাঙা কেন্দ্রে মোট ৪২ হাজার লিড পয়েছেন। রেণুকাদেবী জিতেছেন ৮৭ হাজারের বেশি ভোটে।
যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ভোটে জয়ী তৃণমূলের সুগত বসুকে শুধু ভাঙড়ই দিয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার ভোটের ‘লিড’! আবার জয়নগর লোকসভার ক্যানিং (পূর্ব) বিধানসভা কেন্দ্রের ২২৮ নম্বর বুথে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট যেখানে ৯১০, সেখানে বামফ্রন্ট ও বিজেপি যথাক্রমে পেয়েছে ৩টি ও ১টি ভোট। কংগ্রেস ০! জয়নগরে তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মণ্ডলকে ক্যানিং পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভা যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও ৪১ হাজার ‘লিড’ দিয়েছে। প্রতিমার জয়ের ব্যবধান এক লক্ষ আট হাজারের কিছু বেশি, যার ৮৬ হাজারই ওই দু’টি কেন্দ্র থেকে! ডায়মন্ড হারবার লোকসভার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর বিধানসভার ১০৪ নম্বর বুথে তৃণমূল ৬৪৬টি ভোট পেয়েছে আর তিন বিরোধী দল মিলে পেয়েছে ৯টি ভোট! একই ভাবে বামফ্রন্ট, বিজেপি ও কংগ্রেস মিলে যেখানে ৬টি ভোট পেয়েছে, তমলুকের ময়না বিধানসভার সেই ২৩৫ নম্বর বুথে তৃণমূলের পক্ষে পড়েছে ৫২১টি ভোট।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের দাবি, “শুধু রিগিং করে তৃণমূল জিতেছে, সে কথা বলছি না। ঠিকঠাক ভোট হলে আমরা হয়তো তৃণমূলের জেতা ৩৪টা আসনের কয়েকটা পেতাম আর কয়েকটা আসনে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান অনেকটা কমত। রাজ্যে আমাদের প্রাপ্ত ভোটের হারও কিছুটা বাড়ত।”
বাম জমানায় রিগিং নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করে জিতেছিলেন একমাত্র কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। তাঁর দাবি, “বাম জমানায় ভোটের নামে প্রহসন যা দেখেছি, তিন বছরে এরা তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে!”
পার্থবাবু অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন, “আমরা যদি এতই বিচক্ষণতার সঙ্গে, হিসেব করে ভোটে লড়তাম, তা হলে তো ৪২টা আসনেই জিততাম!”