মানিকতলা বাজারে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
আবার সে এসেছে ফিরিয়া!
অবিকল আগের মতো হয়তো নয়। তবু বাজারের থলে কিংবা দুপুরের তপ্ত ভাতে তার আবাহন ফের জমে উঠছে। দুপুরের এক পশলা বৃষ্টির পরে শোভাবাজার রাজবাড়ির অলককৃষ্ণ দেব ইলিশ ভাজা ও বেগুন-কালোজিরের ইলিশ ঝোল নিঃশেষ করে উঠলেন।
ইদানীং ইলিশে আর স্বাদ পান না তেমন! ইলিশ-কাঁটার সঙ্গে যুদ্ধের সেই মনটাও তাই নেই। তবু শোভাবাজার বাজারের মাছটায় বেশ খানিকটা তেল বেরিয়েছে শুনে অনেক বছর বাদে আস্তিন গুটিয়েছিলেন। নাঃ, স্বাদটা নেহাত মন্দ লাগল না! এক কেজির কম ওজনের এ-সব মাছকে তেমন রন্ধনোপযোগী বলে মানতে নারাজ বাড়ির গিন্নি নন্দিনী দেব বৌরানিও। তবু এ মৎস্য-অবতারের স্বাদে তিনিও বেশ চমৎকৃত।
ইলিশের মতো ইলিশ বলতে একদা খাস বাগবাজার ঘাটের ইলিশই বুঝত সাবেক কলকাতার কিছু বড়-বাড়ি। বিচালিঘাট বা তক্তাঘাটের ইলিশ হলেও তখন তাচ্ছিল্যে মুখ বেঁকাত তারা। আজকের মাঝবয়সীদের কাছে অবধি এ সব কাহিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের বলে মনে হয়! দক্ষিণ কলকাতার রন্ধনপটিয়সী গিন্নি রুকমা দাক্ষীর আবার মনে পড়ছে খুব ছোটবেলায় বাবার আনা ডায়মন্ড হারবারের ইলিশ, যদুবাবুর বাজার কি লেক মার্কেটের পেল্লায় ইলিশের কথা। আজ তার দেখা কোথায়!
বাজারে যে ইলিশ মিলছে, তার গড়পড়তা ওজন মেরেকেটে ৮০০-৯০০ গ্রামের বেশি নয়। কিন্তু আশার কথা এ বছর জোগানে কোনও টান নেই। মানিকতলা, গড়িয়াহাট, দমদম বাজারে ঢুকে আরাম পাচ্ছে মৎস্যপ্রেমীর চোখ। দামও অনেক জায়গাতেই নেমে এসেছে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি দরে। কাজেই বেশ ক’বছর কার্যত আকালের পর পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার ইলিশ-প্রাপ্তিতে এখন উদ্বেল কলকাতা।
“পড়ে পাওয়া নয়তো কী,” বলছিলেন রুকমা। “আজকের ইলিশ কাটলে আলাদা-আলাদা গাদা-পেটির টুকরোই তো হয় না! এক সঙ্গে মিলেজুলে গোল গোল করে পিস করতে হয়।” এ বার অবশ্য লেক মার্কেটের মাঝারি মাপের মাছ ঘরে এনে মোটের উপরে খুশি তিনি। অনেক দিন বাদে হাতের সুঘ্রাণও কিছু ক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল।
সুঘ্রাণ! গত কয়েক বছরে এটুকু ইলিশ-ভাগ্যও তো এই বাংলাকে ছেড়ে গিয়েছিল। রক্ত জল করা পয়সা ইলিশকে উৎসর্গ করার পরে খেতে বসেও মেজাজটা তিরিক্ষি হয়েছে মধ্যবিত্তের। দূর দূর, একেবার পানসে! এ ইলিশ সে ইলিশের ছায়াও নয়। এ বছরের অভিজ্ঞতাটা তুলনায় ভাল বইকী!
এমন শুভ পরিবর্তনের রহস্যটা কোথায়?
এ কোনও যাগযজ্ঞ, গ্রহ-নক্ষত্রের কেরামতি নয়। ইলিশের সুস্বাদ বা ‘তার’-এর নেপথ্যে বরাবরের মতো সেই এক বিজ্ঞানই কাজ করছে। ইলিশ পদ্মার হোক বা গঙ্গার, সাগর থেকে মিষ্টি জলে ঢোকা মাছ মানেই তা স্বাদে এক নম্বর বলে মেনে এসেছেন যে কোনও যুগের ইলিশ-বিশারদেরা। তাঁরা বলেন, বর্ষার বৃষ্টিতে ডিম পাড়তে সাগর ছেড়ে ইলিশের নদী-অভিযান মানেই ভোজন-রসিকদের পোয়াবারো। এবং নদীর যত ভেতরে ঢুকবে ইলিশ, যত মিষ্টি জলের ছোঁয়া পাবে, ততই বাড়বে তার স্বাদ। এখনও সেটাই ঘটছে।
কলকাতার দুর্ভাগ্যের কারণ আছে। ক্রমবর্ধমান নদী দূষণের ধাক্কায় এ শহরের গঙ্গার ঘাটকে কবেই ত্যাগ করেছে ইলিশকুল। ইদানীং রূপনারায়ণের দিকটাতেও তাদের আনাগোনা ক্রমশ বিরল হওয়ায় কোলাঘাটের প্রসিদ্ধ ইলিশও বেশ দুর্লভ। বস্তুত, কোলাঘাটের মতো এ রাজ্যের নদীতীরের বেশ কিছু ‘ইলিশ-পয়েন্ট’ থেকে হাল আমলে ইলিশ প্রায় উধাও হয়েই গিয়েছিল। এ বছর সেই সব পয়েন্টের চিত্র বেশ উজ্জ্বল। ডায়মন্ড হারবারের কাছে নিশ্চিন্তপুর-গদখালি এলাকায় রীতিমতো ভাল ইলিশ উঠছে। সেই সঙ্গে ফরাক্কা বা হুগলির বলাগড় পয়েন্টেও বহু বছর বাদে ইলিশ-দেবতা প্রসন্ন হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন ইলিশ সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা।
আর সাগরে? মৎস্য দফতরের কর্তাদের দাবি, আগে সাগরে ৩০-৪০ নটিক্যাল মাইল না-গেলে ইলিশের দেখাই মিলত না। বড় ট্রলারে সাত-দশ দিনের রসদ নিয়েই অভিযানে সামিল হতেন মৎস্যজীবীরা। কিন্তু এ বার ২০-২৫ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই দেদার মাছ। এমনকী কয়েকটি মোক্ষম ইলিশ-পয়েন্টে ৭-৮ নটিক্যাল মাইল যেতে না যেতেই ট্রলার উপচে পড়ছে।
স্বভাবতই রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বা ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা সপ্তর্ষি বিশ্বাস সবার মুখেই চওড়া হাসি। মৎস্যমন্ত্রীর কথায়,“অনেক দিন বাদে বাঙালির পাতে ভদ্রস্থ পিসের ইলিশ!” ছোট ইলিশ ধরার বিরুদ্ধে সরকারি প্রচার কাজে এসেছে বলে মনে করছেন তিনি। সপ্তর্ষিবাবুরও ব্যাখ্যা, “ছোট মাছ ধরা কিছুটা বন্ধ হওয়াতেই আগের থেকে বড় সাইজের ইলিশের দেখা মিলছে। ছোট ফাঁসের জালও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ইলিশ তারই সুফল!”
মৎস্য দফতরের হিসেব, ২০১২-১৩ সালে মাত্র ৮,৬৭৯ টন ইলিশ ধরা গিয়েছিল। ২০১৩-১৪ সালে প্রাপ্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪৩৬ টনে। জলের ‘রুপোলি শস্যে’র অভিযানে এখনও সাগরে পাঁচ হাজার ট্রলার। ‘ফসল’ বোঝাই করে নিয়মিত কাকদ্বীপ-ডায়মন্ড হারবার বা দিঘা-শঙ্করপুরে নোঙর করছে তারা। সরকারি কর্তাদের আশা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি জারি থাকলে ইলিশের আনাগোনা অটুট থাকবেই। সে ক্ষেত্রে ইলিশ-লাভের আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। অবশ্য মৎস্য দফতরের কর্তাদেরই একাংশ বোঝাচ্ছেন, পাঁচ বছর অন্তর এমনিতেই ইলিশ কিছুটা বেশি ধরা পড়ে। আগামী বছরে ইলিশ-ভাগ্যে ফের ভাটার টান আসবে।
মানিকতলা বাজারের চেনা মুখ সত্যেন সরকার অবশ্য এ সব আশঙ্কায় অবিচলিত! অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীর দাবি, “দামটা একটু পড়ে আসায় এখন তো দু’দিন অন্তর ইলিশ খাচ্ছি। এই ক’টা দিন ডাক্তারের নিষেধ থোড়াই কেয়ার!” বাস্তবিক, বাজারের আলু থেকে রুই, কাতলা, আড়, বোয়াল, ভেটকি, পাবদা সবার দামেই এখন হাতে ছেঁকা লাগছে। রোজ মাছ খাওয়াটা অনেকের কাছেই মুখের কথা নয়। জামাইষষ্ঠী বা বর্ষার শুরুতে ইলিশের কেজি দর হাজার-দেড় হাজারের কমে কথা বলছিল না। সেই দামটাই দিন ১০-১২ হল, খানিক পড়েছে। জোগানও বিপুল। আম বাঙালি অতএব রোজ-রোজ না-হলেও বেশ ঘন-ঘন ইলিশের আশায় হামলে পড়ছে। দমদমের মাছবিক্রেতা আনন্দ দাস আহ্লাদে আটখানা, “আর সব মাছ ফেলে লোকে এখন শুধুই ইলিশ নিচ্ছে! বর্ষার ক’টা দিন বই তো নয়!”
সুন্দরবন-দিঘার এই দিশি ইলিশের প্রাপ্তিযোগটুকুর সঙ্গে আর এক ছটাক আশার আলোও ঝিলিক দিচ্ছে। আগামী ৫ অগস্ট দিল্লিতে বৈঠকে বসছেন ভারত ও বাংলাদেশের কর্তারা। বৈঠকে ইলিশ-প্রসঙ্গও ওঠার কথা। ঢাকার বিধিনিষেধের জেরে শহরের বাজারে বাংলাদেশের ইলিশ এমনিতে ডুমুরের ফুল। যেটুকু আসে, চোরাগো
সহ-প্রতিবেদন: ঋজু বসু, পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়