কোরপানের স্ত্রী-সন্তানদের পাশে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। রয়েছেন প্রাক্তন সাংসদ সুধাংশু শীলও (একেবারে ডান দিকে)। সোমবার, এন্টালি থানার সামনে প্রতিবন্ধীদের বিক্ষোভ সমাবেশে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
নাগরিক সমাজ সে ভাবে পথে নামেনি। কথা দিয়েও প্রতিবাদ থেকে কার্যত দূরে থেকেছে ‘হোক কলরব’-এর প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ। তবে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে মানসিক রোগী কোরপান শা’কে পিটিয়ে খুনের ন’দিন বাদে নৃশংস ওই ঘটনার এক অন্য ধরনের প্রতিবাদের সাক্ষী হল শহর। সোমবার শ’পাঁচেক প্রতিবন্ধী কোরপানের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে গেলেন এন্টালি থানার সামনে।
এনআরএস-কাণ্ড নিয়ে নাগরিক বা ছাত্রসমাজের মধ্যে বিশেষ হেলদোল নেই বলে ইতিমধ্যে নানা মহলে আক্ষেপ শোনা গিয়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিবন্ধীদের এ হেন পদক্ষেপ বাস্তবিকই আলোচনার বিষয়বস্তু। নিছক বিক্ষোভ প্রদর্শন নয়, এ দিন হুইলচেয়ার দিয়ে তাঁরা থানার প্রবেশপথ আটকে দেন। এমনকী, কোরপান-হত্যার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে মিনিট পনেরো সিআইটি রোড অবরোধও করেন। বিক্ষোভকারীদের হাতে-হাতে ঘুরেছে প্রতিবাদ ও দাবির স্লোগান তোলা বিবিধ প্ল্যাকার্ড-পোস্টার। তার ভিড়ে চোখে পড়েছে এমন পোস্টারও, যাতে আক্ষেপ, ‘কবরে কাঁদে কোরপানের দেহ, নেই কলরব।’
তবে এনআরএস-হত্যার সুসংহত প্রতিবাদের কোনও মঞ্চ এখনও তৈরি না-হলেও তদন্তে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং এনআরএস-কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার নালিশ তুলে একটি মানবাধিকার সংগঠন এ দিন হাইকোর্টে মামলা করেছে। তাতে এনআরএসের অধ্যক্ষ, মেডিক্যাল সুপার ও হস্টেল সুপারকেও পক্ষ করা হয়েছে বলে সংগঠনটির তরফে জানানো হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসন কিছুটা মুখরক্ষার চেষ্টায় নেমেছে, যার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেও দেরি হয়নি। কী রকম?
পুলিশ-সূত্রের খবর: এনআরএস-কাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার (আইও)-কে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লালবাজারের কর্তারা। বলা হচ্ছে, ওই আইও আগে থেকেই বিয়ের জন্য ছুটির আবেদন করে রেখেছিলেন। মঙ্গলবার থেকে তিনি ছুটিতে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, আলিপুর থানায় ভাঙচুরের তদন্তে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে শোরগোল ওঠার পরে সেখানকার আইও’কে বদলানো হয়েছে। একই ভাবে এ বার এনআরএস-হত্যার তদন্তকারী অফিসারের দায়িত্ব যাচ্ছে এন্টালি থানার অতিরিক্ত ওসি-র হাতে। পুলিশকর্তারা বলছেন, ওখানকার ওসি ছুটিতে থাকায় এত দিন এই বদল করা হয়নি। নতুন হাতে তদন্তের দায়িত্ব যাওয়ায় কতটা লাভ হবে, খাস লালবাজারের অন্দরে সে সংশয় জোরদার। অনেকের বক্তব্য, শাসকদলের চিকিৎসক-নেতাদের একাংশের চাপেই যে পুলিশ কাজ করতে পারছে না, সেটা এক রকম পরিষ্কার। অতএব শুধু আইও পাল্টে তদন্তে গতি আনা কঠিন। বস্তুত একই ঘটনা নিয়ে এন্টালি থানা ও লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ যে ভাবে আলাদা তদন্ত চালাচ্ছে, তাতে সমন্বয়ের বিস্তর অভাব। তদন্ত পণ্ড করার উদ্দেশ্যেই এমন বিচিত্র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না, পুলিশমহলে সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। সিদ্ধান্তের নেপথ্যে শাসকদলের ‘চাপের’ কথাও শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু শাসকদলের নেতারা এখানে হস্তক্ষেপ করছেন কেন?
লালবাজার-সূত্রের ব্যাখ্যা: কোরপান-হত্যায় অভিযোগের তির যে সব হবু ডাক্তারের দিকে, তাঁদের অনেকেই তৃণমূলের ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত। স্বভাবতই তাঁদের বাঁচাতে দলের স্বাস্থ্য সেলের মাথারা সক্রিয়। লালবাজারের এক অফিসারের কথায়, “ধরপাকড় এড়াতেই গোয়েন্দা বিভাগের হাতে পুরো দায়িত্ব ছাড়া হচ্ছে না। ফলে তদন্ত দ্রুত এগোচ্ছে না। হস্টেলের আবাসিকদের জেরা করার ক্ষেত্রেও দু’টো দল আলাদা ভাবে কাজ করছে কেন, তা মাথায় ঢুকছে না।” ওই অফিসারের মতে, নেতারা যতক্ষণ দোষীদের আড়াল করতে চাইবেন, ততক্ষণ আইও পাল্টে কোনও লাভ হবে না।
গত ১৬ নভেম্বর কাকভোরে এনআরএস বয়েজ হস্টেলের চারতলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় মিলেছিল কোরপানের মৃতদেহ। ছাত্রাবাস-কর্মীদের কয়েক জন জানিয়েছিলেন, মোবাইল চোর সন্দেহে মানসিক রোগী যুবকটিকে থামের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে কিছু ছাত্র। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ কিন্তু পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। পরে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি খুনের মামলা রুজু করে। কেউ অবশ্য গ্রেফতার হয়নি। পুলিশের একাংশের অভিযোগ: এনআরএস-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কাঙ্খিত সহযোগিতা মিলছে না। ওই রাতে হস্টেলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নাম-ঠিকানা-ছবি চাওয়া হলেও হাসপাতাল অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়েছে। বারবার চেয়েও সম্পূর্ণ তালিকা মেলেনি।
পুলিশকে ঠিকঠাক তালিকা দেওয়া হচ্ছে না কেন? হাসপাতালের এক সূত্রের ইঙ্গিত, শাসকদলের প্রভাবশালী চিকিৎসক-নেতাদের চাপেই কর্তৃপক্ষ পুলিশকে তালিকা ধরাচ্ছেন না। ব্যাপারটা জানতে এ দিন এনআরএসের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হয়। তাঁরা কেউ ফোন তোলেননি, এসএমএসের জবাবও দেননি।
এ দিন এন্টালি থানায় প্রতিবন্ধী-বিক্ষোভেও বিষয়টি সামনে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর উদ্যোগে আয়োজিত ওই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। কান্তিবাবু বলেন, ‘‘কোরপান-খুনের বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে আগামী ৩ ডিসেম্বর, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে পাঁচ হাজার প্রতিবন্ধী রাস্তায় নামবেন।”