কফিনে ফিরল রিয়া, বাঁধ ভাঙল কান্না

বিকেল পৌনে পাঁচটার সময় সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কফিন বন্দি দেহ যখন জলপাইগুড়ির পাহাড়িপাড়ায় পৌঁছল, পাড়া ছাপিয়ে ভিড় তখন পৌঁছে গিয়েছে কদমতলা মোড়ে। কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন শহরের মেধাবী মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে। রবিবার সকালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় এম এসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমন্তিকার দেহ উদ্ধার হয় কলেজ স্ট্রিটের আরপুলি লেনের একটি বাড়ি থেকে। সেই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকতেন তিনি। সেই খবর পাওয়া মাত্র পাহাড়িপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার শোকে ভেঙে পড়ে।

Advertisement

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০২
Share:

সুমন্তিকার দেহ ঘিরে জলপাইগুড়ির পথে ভিড়। সন্দীপ পালের তোলা ছবি।

বিকেল পৌনে পাঁচটার সময় সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কফিন বন্দি দেহ যখন জলপাইগুড়ির পাহাড়িপাড়ায় পৌঁছল, পাড়া ছাপিয়ে ভিড় তখন পৌঁছে গিয়েছে কদমতলা মোড়ে। কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন শহরের মেধাবী মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে।

Advertisement

রবিবার সকালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় এম এসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমন্তিকার দেহ উদ্ধার হয় কলেজ স্ট্রিটের আরপুলি লেনের একটি বাড়ি থেকে। সেই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকতেন তিনি। সেই খবর পাওয়া মাত্র পাহাড়িপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার শোকে ভেঙে পড়ে। বেলা বাড়তে শোক ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরে। সুমন্তিকা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক স্তরে খুব ভাল ফল করেছিলেন। মেধাবী এই ছাত্রীটি তাঁর স্বভাবের জন্যও শহরে খুব প্রিয় ছিলেন। সে দিন বিকেলেই কলকাতায় সুমন্তিকার দেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। তারপরেই জানা যায়, তাঁর দেহ সোমবার জলপাইগুড়ির বাড়িতে আনা হবে।

সেই মতো এই দিন সকাল থেকেই একটু একটু করে ভিড় জমছিল পাহাড়িপাড়ায় সুমন্তিকাদের বাড়ির সামনে। সারা রাত বাড়ির কেউই প্রায় ঘুমোতে পারেননি। ঘুম আসেনি পাড়ার অনেকের চোখেও। কলকাতা থেকে সড়ক পথে সুমন্তিকার দেহ নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর কাকা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সুমন্তিকার বাবা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার ঘরবার করছিলেন। বাড়ির বাইরে ভিড় দেখে তিনি একবার জানতে চান, এত লোক কেন? তাঁর মেয়ের জন্যই সবাই অপেক্ষা করছেন শুনে কান্না ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সুমন্তিকার মা শিপ্রাদেবী অবশ্য রবিবার মেয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে এক ঠায় বসেছিলেন। এ দিন তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। রাতে শ্মশান থেকে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেবাশিসবাবুও।

Advertisement

প্রিয় ছাত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ পাহাড়িপাড়ায় পৌঁছে যান জলপাইগুড়ি শহরে সুমন্তিকা যে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সেখানকার প্রিন্সিপ্যাল সিস্টার ক্রিস্টিন এবং অন্য শিক্ষিকারা। সরকারি আইনজীবী সোমনাথ পাল থেকে প্রাক্তন সাংসদ জিতেন দাস, শহর বিজেপির যুব নেতা জয়ন্ত চক্রবর্তী, কে নেই তখন ওই লোকারণ্যে। সকলেরই প্রশ্ন, কী করে হল এমন ঘটনা?

বিকেলে সুমন্তিকার দেহ পৌঁছনোর পরে এত ক্ষণের জমাট বেঁধে থাকা কান্নাটা ভেঙে পড়ে। সুমন্তিকার একমাত্র ভাই দেবকঙ্কণ কান্নায় ভেঙে দিদির কফিন জড়িয়ে ধরেন। অচেতন শিপ্রাদেবীকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেখান থেকে। তারপরে বিরাট জনতাকে সঙ্গে নিয়েই সুমন্তিকার বাড়ির লোক তাঁর দেহ নিয়ে যান শহরের মাষকলাইবাড়ি শ্মশানে। সেখানেও শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন প্রায় হাজারখানেক মানুষ।

তবে ক্ষোভের পারদও চড়ছে। কেন ওই ছাত্রীকে অকালে চলে যেতে হল দ্রুত পুলিশি তদন্ত শেষ করে কারণ সামনে তুলে আনতে হস্তক্ষেপ চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর্জি জানাতে চান সুমন্তিকার বাড়ি যেখানে সেই শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড পাহাড়িপাড়ার বাসিন্দাদের একাংশ এবং জলপাইগুড়ির সাংসদ। আজ, মঙ্গলবার তা নিয়ে সুমন্তিকার পরিবারের সঙ্গে কথা বলবেন স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি।


সুমন্তিকার দেহ এল। শোক পাড়ায়।

রবিবার সুমন্তিকার দেহ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়তে একই প্রশ্ন পাহাড়িপাড়ার বাসিন্দাদের মতো শহরকে তাড়া করে ফিরেছে---কী এমন হল যে, মেয়েটি মৃত্যুর কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে? সোমবার কলকাতা থেকে সুমন্তিকার নিথর দেহ শহরে পৌঁছতে আরও তীব্র হয়েছে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে ময়নাতদন্ত এবং দেহ রসের ফরেন্সিক পরীক্ষার না করেই আগে কেমন করে বলা হল মাদক জাতীয় কোন কিছুর বিষক্রিয়ায় মেধাবী ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ক্ষুব্ধ সুমন্তিকার পরিবারের ঘনিষ্ট মানস মজুমদার বলেন, “প্রত্যেকে চায় মৃত্যুর কারণ সামনে উঠে আসুক। কিন্তু তদন্ত শুরু না হতে কেন আপত্তিজনক কথার প্রচার চলবে?” পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলার নির্মল ঘোষদস্তিদার জানান, সুমন্তিকা নেহাতই আর দশ জন মেধাবী ছাত্রীর মতো ছিল না। সে পাড়ার গর্ব ছিল। তাঁর মৃত্যুর রহস্য দ্রুত উন্মোচন করা জরুরি। শুরু থেকে যে ধরনের প্রচার চলেছে, সেটা কেউ ভাল ভাবে নেয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা রত্না সরকার বলেন, “সেই ছেলেবেলা থেকে মেয়েটি চোখের সামনে বড় হল। তার এ ভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।” সুমন্তিকাদের বাড়ির উল্টো দিকে চক্রবর্তী বাড়ি। ওই বাড়ির বধূ শম্পা দেবী বলেন, “আমাদের বাড়ির উঠোনে মেয়েটি খেলত। প্রেসিডেন্সিতে ভর্তির পরেও বাড়িতে এলে চলে আসত। কোনদিন ওর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি। সেখানে বলা হল, মাদক খেয়ে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে! এত অপমান!” অপমান থেকে রেহাই পেতে দ্রুত তদন্ত শেষ করার দাবিতে সরব হয়েছেন সুমন্তিকার পরিবার এবং পাহাড়ি পাড়ার বাসিন্দারা।

সুমন্তিকার একমাত্র মামা রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা মৃত্যুর কারণ জানতে চাই কিন্তু তদন্ত শেষ না হতে যে ভাবে বিভিন্ন জন মন্তব্য করে চলেছেন সেটা দুর্ভাগ্যজনক।” তদন্তের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ বিজয়চন্দ্র বর্মণ। তিনি বলেন, “দিল্লিতে আছি। দু-একদিনের মধ্যে ফিরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাব।” পাহাড়িপাড়ার বাসিন্দা তথা তৃণমূলের প্রদেশ সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন, “মেয়েটির মৃত্যু নিয়ে যে ধরনের প্রচার চলছে মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত তদন্ত শেষ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমি নিজে আর্জি জানাব ওই বিষয়ে ওর পরিবারের সঙ্গেও কথা বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন