বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএফঅাই-টিএমসিপি সংঘর্ষ। — ফাইল চিত্র।
কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এখনও ঢের দেরি। আগামী বছর বিধানসভা ভোটের পরে শুরু হবে সেই ভোট-পর্ব। কিন্তু তার অনেক আগেই তাকে শিরোনামে তুলে আনলেন তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়। শনিবার আশুতোষ কলেজের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র সংসদের নেতাদের বলছি, গণতান্ত্রিক ভোটের পরিস্থিতি নিয়ে এসো। কোনও দল মনোনয়ন জমা দিতে পারল না, সেই ভোটের কোনও অর্থই হয় না। এতে জনপ্রিয়তা যাচাই করা যায় না।’’
পরিবর্তনের পরে রাজ্যের কলেজগুলিতে এখন টিএমসিপি-র বিজয়রথ হইহই করে ছুটছে। শেষ দফায় রাজ্যের ৫১৩টি কলেজের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে ৪৭০টিতে। সেই ভোটের ফলাফলে টিএমসিপি-র দখলে এসেছে ৪৫২টি ছাত্র সংসদ। তার মধ্যে ৩০০টিতেই তারা জিতেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়!
টিএমসিপি-র এই ‘কৃতিত্ব’কে কার্যত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন আশুতোষ কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক সৌগতবাবু। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা যে আসলে জবরদস্তি একচেটিয়াপনা কায়েম করা, পরোক্ষে তা-ই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রকারান্তরে এই জয়ে দাঁড়িপাল্লার উল্টো দিকে যে আসলে হিংসা ও পেশি-রাজনীতি রয়েছে, তাঁর দলের ছাত্রনেতাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন বলে শিক্ষানুরাগীদের অনেকের ধারণা।
বাস্তব চিত্রও তারই সাক্ষ্য দেয়। এ রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বলতে গেলে সাধারণ নির্বাচনের চেহারা নেয়। বাম আমল থেকে চলে আসা এই রীতি এখনও বহমান। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় বিরোধী দলের জাঠায় শাসক দলের অনুগামীদের আক্রমণের জেরে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ এখন রাজ্যে চর্চিত বিষয়। কলকাতা বা বিধাননগর পুর নির্বাচনকে ঘিরেও একই প্রশ্ন সামনে এসেছিল। অনেকের মতে, এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি আসলে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা তৈরির পাঠশালা। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তারই প্রকাশ ঘটে। তারই জেরে অন্তত ১০০ কলেজে মনোনয়নপত্র তুলেও জমা দিতে পারেনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলি। আর ১৫০টি কলেজে তো মনোনয়নপত্র তুলতেই পারেনি তারা! আর যেখানে সাহসে ভর করে মনোনয়নপত্র তুলে নির্দিষ্ট সময়ে
জমা দিতে পেরেছেন বিরোধী প্রার্থীরা, সেখানেও নির্বাচনের আগে-পরে হিংসার কবলে পড়তে হয়েছে তাঁদের। এই রাজ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় যে আসলে হিংসা বা শাসানিরই জয়, প্রাক্তন শিক্ষক সৌগতবাবু অল্প কথায় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। এ দিন যেন ঘুরিয়ে সেই কথাই মনে করিয়ে দিয়ে সৌগতবাবু বলেছেন, ‘‘নেতা হতে গেলে ভোট করে এসো। ভোট না করা সোজা। ভোট করাটাই কঠিন।’’
সৌগতবাবু যখন মঞ্চে, তখন শ্রোতার আসনে বসে ওই কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই অনুষ্ঠানের পরে সৌগতবাবুর মন্তব্য সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান সাংবাদিকরা। পার্থবাবু বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’’ যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কলেজে কলেজে টিএমসিপি-র ‘দাদাগিরি’কে পার্থবাবু শক্ত হাতে সামাল দিতে চাননি বলে বার বারই অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যের পাঁচশো-রও বেশি কলেজের মধ্যে অল্প কয়েকটিতে গোলমালকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে তুলে ধরে তা রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রের সার্বিক সমস্যা নয় বলে ঘটনাগুলিকে বরং লঘু করেই দেখিয়েছেন পার্থবাবু।
সৌগতবাবু অবশ্য এর আগেও এক বার চাঁছাছোলা মন্তব্য করে পার্থবাবুকে বিড়ম্বনায় ফেলেছিলেন। ভাঙড় কলেজের শিক্ষকদের বসার ঘরে এক শিক্ষিকার দিকে জলের জগ ছুড়ে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম তখন খবরের শিরোনামে। তখন এই আশুতোষ কলেজেই এক অনুষ্ঠানে এসে আরাবুলের নাম না করে সৌগতবাবু বলেছিলেন, ‘‘অষ্টম শ্রেণি পাশ না করেই অনেকে কলেজের পরিচালন সমিতিতে বসে রয়েছেন! তাঁদের থাকা উচিত নয়।’’ এ দিনও পরোক্ষে টিএমসিপি-র সমালোচনা করেই কার্যত তিনি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালেন বলে অনেকের ধারণা।
অবশ্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জবরদস্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার কৃতিত্ব মোটেই তৃণমূলের একচেটিয়া নয়। বাম আমলে এই ব্যাপারে সব চেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর। রাজ্যের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে সিপিএম নেতা গৌতম দেবও বলেছিলেন, ‘‘মেরে ধরে সবাইকে ভাগিয়ে দিয়ে ভোটে জেতাটা গণতন্ত্র হতে পারে না। বামেরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল। বিশেষত কিছু কলেজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ তৈরি হত। কিন্তু কলেজগুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো বিরোধী ছাত্র সংগঠনের এক জনও থাকবে না, এটা হতেই পারে না। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল ইঙ্গিত নয়।’’ বাম ছাত্র সংগঠনের ওই কীর্তির কথা মেনে নিয়ে গত এপ্রিলে পুরভোটের সময়ে ভুল শুধরে নেওয়ার কথাও বলেছিলেন গৌতমবাবু। আর শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির দাপাদাপি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূল যে তা বেবাক ভুলেই গিয়েছে এবং তার জন্য দলেই সৌগতবাবুর মতো কিছু নেতার আক্ষেপ রয়েছে, এ দিনের ঘটনা ফের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল।
টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রও অবশ্য গণতন্ত্রের কথাই বলেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘গণতন্ত্র আমরাও চাই। গোটা রাজ্যে ৪৫২টি কলেজে আমরা জিতেছি। তার মধ্যে ১৫২টি কলেজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। বাকিগুলিতে প্রার্থীই দিতে পারেনি বিরোধীরা। কারণ রাজ্যে আমাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন দিতে পারার মতো জায়গাতেই নেই তারা!’’
এসএফআই-এর রাজ্য সভাপতি মধুজা সেন রায় বলেন, ‘‘সৌগতবাবু আগে শিক্ষামন্ত্রীকে বলে নিশ্চিত করুন, এ বারের ছাত্র সংসদ নির্বাচন যাতে নিরুপদ্রবে হয়! তবে ওই দলের নেতারা যা বলেন, ছাত্ররা তার উল্টোটাই করেন!’’ কিন্তু বাম আমলেও তো এমনই হতো? মধুজার মন্তব্য, ‘‘সেই সময়েও বিরোধীরা কিন্তু বহু কলেজেই সংসদ গঠন করেছে। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বিরোধীদের তো কোনও ঠাঁই-ই হচ্ছে না!’’ এবিভিপি-র রাজ্য সম্পাদক সুবীর হালদারের সুর অবশ্য কিছুটা নরম। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের সম্মান করার কথা বললেও তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে যারা শিক্ষক নিগ্রহ করে, তাদের কাছে সৌগতবাবুর মন্তব্য তো মূল্যহীন।’’