গুড়-জলে ভোট করিয়ে অট্টহাসি অনুব্রতর

ঠিক বেলা এগারোটায় নিচুপট্টির সাবেকি বাড়ির দোতলা থেকে নীচের বৈঠকখানায় নামলেন তিনি। বাইরে ততক্ষণে বেশ কয়েকটি ওবি-ভ্যান জড়ো হয়েছে। “দাদা, লাইভ-এ চাইছে অফিস”, সকলেরই এক আর্জি। তাঁর কিন্তু সেদিকে নজর নেই। এক দেহরক্ষীর মোটরবাইকের পিছনে বসলেন। এসএলআর হাতে আরও জনা আটেক রক্ষী উঠে বসল অন্য কয়েকটি বাইকে। “রুবাই উঠেছিস?”

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

বোলপুর শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৪:২৭
Share:

ঠিক বেলা এগারোটায় নিচুপট্টির সাবেকি বাড়ির দোতলা থেকে নীচের বৈঠকখানায় নামলেন তিনি। বাইরে ততক্ষণে বেশ কয়েকটি ওবি-ভ্যান জড়ো হয়েছে। “দাদা, লাইভ-এ চাইছে অফিস”, সকলেরই এক আর্জি। তাঁর কিন্তু সেদিকে নজর নেই। এক দেহরক্ষীর মোটরবাইকের পিছনে বসলেন। এসএলআর হাতে আরও জনা আটেক রক্ষী উঠে বসল অন্য কয়েকটি বাইকে।

Advertisement

“রুবাই উঠেছিস?”

“হ্যঁা।” জানাল বীরভূমের এই কাঠখোট্টা নেতাকে ধমক দেওয়ার একমাত্র অধিকারিণী, কন্যা। “চলো, ভোটটা দিয়ে আসি।”

Advertisement

কেষ্ট মণ্ডল (অনুব্রত) বেরোলেন ভোট দিতে।

ভাগবত প্রাথমিক স্কুলে ভোট সেরে নেতাজি রোডের পার্টি অফিসে। দাদার বসার ঘরে তিনটি ঠান্ডি-যন্ত্র চলছে। “বীরভূমের গরম, তার উপর দাদাও গরম, তাই আর কী!” ঠান্ডি-যন্ত্রের দর্শন বাতলে দিলেন এক অনুগামী।

হুকুম এল “ব্লক সভাপতিদের এক এক করে ধরে দে, দেখি ভোট কেমন হচ্ছে!”

এই প্রথম কেষ্ট-দর্শনে যাওয়া সাংবাদিকের দিকে তাকানোর ফুরসত পেলেন অনুব্রত। “আজ সকাল সাতটায় বাড়ি ফিরেছি, গাড়িটা পর্যন্ত রাতে বিগড়ে গিয়েছিল। ভোট তো আমার কালকেই সারা হয়ে গিয়েছে।” চওড়া গোঁফের নীচে লুকনো হাসি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “দেখবেন কাউকে চড়ও মারতে হবে না। শান্তিতে ভোট হয়ে যাবে।”

একে একে ব্লক সভাপতিদের ধরা শুরু হল। কখনও তারও নীচের অঞ্চল সভাপতিদের। যা নাকি কেষ্টদার নিজস্ব নেটওয়র্ক। পাশে বসে রানা সিংহ নোটবুক হাতে তৈরি।

“নুরুল, খবর কী?” সিউড়ি-২ ব্লকের সভাপতি জানালেন, ভাল ভোট হচ্ছে। নেতা জানতে চাইলেন, “সোনা বাবা আমার, বুথে বুথে জল রেখেছ তো? খুব গরম তো, ঠান্ডা করতে লাগতে পারে।” জানি না, কী উত্তর এল। কিন্তু অনুব্রত চোখ তুলে চারপাশটা দেখে নিয়ে চলে গেলেন পরের ফোনে। মুরারইয়ের সাবের আলি। “কী খবর সাবের? সব ‘ওকে’ তো? জল রেখেছ? আর গুড়? বেশ বাবা, গুড়-জল দিয়ে ভোটটা কর। খুব গরম, দেখে নিও একটু!”

দাদা, আপনারা কি বুথে বুথে গুড়-জল রেখেছেন? হো হো করে হেসে ফেললেন কেষ্টদা। জানালেন, গরমে ভোট হচ্ছে, তাই গুড়-জলের সামান্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। “ঠান্ডা করতে গুড়-জলের থেকে ভাল ওষুধ আমার অন্তত জানা নেই। আমি তো আয়ুর্বেদের লোক।”

পরপর ধরা হল দীপক, জয়নাল, সুকুমার, বিনয়, স্বর্ণ, আনারুল, গদাই, শাহনওয়াজ, শাহ আলমকে। সবাই জানিয়ে দিলেন ভোট ‘শান্তিপূর্ণ’। শুধু খবর এল রসা-বরা গ্রামে পুলিশ বুথের সামনে টহল দিচ্ছে। ফের হুকুম, “ধর তো ওসিকে।” নিমেষে মোবাইলে এলেন ওসি। দাদা বললেন, “কী করছে আপনার পুলিশ? এত রোদে মাথা ঘুরে যাবে তো! যান যান, ছায়ায় যান। বিশ্রাম নিন।” বোঝা গেল না, রসা-বরাতে পুলিশ রোদ থেকে ছায়ায় চলে গেল কি না। তবে পুলিশি তত্‌পরতা নিয়ে সারাদিনে আর ফোন এল না। প্রথম রাউন্ড খোঁজখবর করে অনুব্রতের গোঁফের নীচের মুচকি হাসিটা অট্টহাসিতে পরিণত হল। এবং অবধারিত প্রশ্ন এল, “আপনাদের রাকেশবাবু কোথায়? এখনও তো কোনও আওয়াজ শুনলাম না।”

দোর্দণ্ডপ্রতাপ অনুব্রত এ বার কিছুটা আবেগপ্রবণ। “জানেন, গত আড়াই মাস আমার উপর দিয়ে কী গিয়েছে? তবুও চাপটা কাউকে বুঝতে দিইনি। একদিন শুনলাম, আমার জন্য নাকি সিউড়ি জেলে ঘর পরিষ্কার পর্যন্ত করা হয়ে গিয়েছে। বাড়ির সামনে সারা রাত মিডিয়ার লোকজন। সেই রাতেই নাকি আমাকে গ্রেফতার করা হবে। এক দিন দিদি ফোন করে জানতে চাইলেন, কী রে টেনশন হচ্ছে? আমি বললাম, তুমি আছ তো আমার সঙ্গে। আমার আর কীসের টেনশন!”

তাহলে দিদির বলেই আপনি বলীয়ান? “হ্যাঁ, দিদি আর মহাদেব। ওই ব্যোমভোলের আশীর্বাদ না

নিয়ে বেরোই না। মহেশ্বরই আমার প্রধান শক্তি।”

সেটা অবশ্য এ দিন সকালে নিচুপট্টির দোতলা থেকে আগেই জেনে এসেছি। ছিমছাম বেডরুমে নজরে আসে কেবলমাত্র ওই অক্সিজেন মাস্ক আর বড় একখানা এলসিডি টিভি। কেষ্ট মণ্ডলের শোয়ার ঘরের জীর্ণ জৌলুস কলকাতার নেতারা কল্পনাও করতে পারবেন না। একেবারে সাদামাটা। ২৪ বছরের বিবাহিত জীবনে এই প্রথম ভয় পেয়েছিলেন পাড়ুই-পর্বে, অকপট জানালেন ছবি মণ্ডল। অনুব্রতবাবুর স্ত্রী-র কথায়, মহাদেবের মাথায় বেলপাতা না চড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোন না দাদা।

মাঝে মাঝে কি আক্ষেপ হয় দাদার রাজনীতি নিয়ে? ছবি দেবী বলেন, “না, তা হয় না। তবে টেনশন তো হয়। জানেন তো, কিছুই বলে না বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করলে বলে, ধুস! কিচ্ছু হয়নি। একদিন বললাম, তুমি শুধু ‘না, না’ বলো! টিভিতে সব দেখছি আমরা।” স্ত্রীর মুখে কোথাও যেন ভালবাসাজনিত ভয়ের সুর। কেষ্টদাও বলেন, “আপনার বৌদি সুস্থ ছিল। আমার জন্যই টেনশন করে অসুস্থ হয়েছে। কী করব? নানুর-পর্বের পরও যখন বেঁচে আছি, তখন আর মৃত্যুভয় করি না। নিয়তিকে কে খণ্ডাতে পারে?”

অনুব্রত বলেই চলেন, “এক সময় গরিব মানুষের জন্য মুদিখানার বিশাল দোকান পর্যন্ত লাটে তুলে দিয়েছি। দিনরাত এক করে লড়েছি। আজ যখন বীরভূমের মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছি, তখন নানা কথা হচ্ছে।”

নানা কথার মাঝেই দাদার চোখ যায় ঘড়ির দিকে। “ওরে, একটা বাজল! আর একবার দেখ, কেমন ভোট হচ্ছে! আর খাওয়ার ব্যবস্থা কর।” ভোটের দিনে পার্টি অফিসে সবার জন্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থা। কেষ্ট দা খেলেন মুড়ি, লঙ্কা, শশা, একটু মুগডাল আর চারা পোনা। আজকাল নাকি নিরামিষই খান। “ভোটের দিন, তাই এক টুকরো মাছ খেলাম”, জানালেন অনুব্রত। মাঝে মুকুল রায়ের ফোন এল। “দুটোই দিচ্ছি দাদা, নিশ্চিন্ত থাকো।” ধরলেন শতাব্দীকে। কোথায় তুমি? প্রার্থী জানালেন, সিউড়িতে। কেষ্টদার পরামর্শ, “যাও তুমি জিতে গেছো। আরও বেশি লিড পাবে। আমি সিউড়ি ঢুকছি। তুমি নলহাটির দিকটা চলে যাও।”

এ বার জেলা সদরে গিয়ে পরিস্থিতি যাচাইয়ের পালা। তার আগে আরও এক দফা খোঁজ হল। নলহাটির শাহ আলমকে নির্দেশ, “শোন, আর ঘণ্টা দুয়েক বাকি। খোল-বিচালি দিয়ে বলদগুলোকে গোয়ালে দিয়ে আয়।” লিটন মণ্ডলকে নির্দেশ, “এ বার ছাগলগুলোকে ঘাস খাওয়াতে পাঠা।” এমন প্রতীকী নির্দেশের ব্যাখ্যা চাওয়া বোকামি। যেখানে কেষ্টদা নিজেই বলছেন, “ইশারা ইজ দ্য কাফি।”

ফলে ইশারা বুঝে সিউড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। বোলপুর নেতাজি রোড থেকে সোজা গাড়ি গিয়ে থামল সিউড়ির ষষ্ঠীতলায়। ভোট তখন আর ঘণ্টাখানেক। এ দিন অনুব্রতর সর্বক্ষণের সঙ্গী বীরভূম প্রাথমিক বোর্ডের সভাপতি রাজা ঘোষ। বললেন, “অনেক দিন পর এমন হাসতে দেখলাম দাদাকে।”

তা হলে রাকেশ-দাওয়াইয়ে কাজ হল না? কেষ্ট মণ্ডল তখন হাসছেন। আর বলছেন, “আসলে আমি তো আয়ুর্বেদ খাই। উনি (সুধীরকুমার রাকেশ) অ্যালোপ্যাথির ওষুধ দিয়েছেন। তাই ওষুধ কাজ করেনি। তবে তাঁকে ধন্যবাদ, থ্যাঙ্ক ইউ রাকেশজি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন