ঘাড়ে চাপের খাঁড়া, তাই চুপ প্রশাসনের কর্তারা

এক জন জনপ্রতিনিধি গুলি-খুন-রেপ করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন! সে কথা সামনে আসার পর কয়েক দিন কেটে গেলেও রাজ্য ও জেলা প্রশাসন তা নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি! যে এলাকায় ওই সব কথা বলেছেন তাপসবাবু, তা নাকাশিপাড়া ও তেহট্ট থানার অন্তর্গত। কাছেই ফাঁড়ি। পরপর তিন জায়গায় সভা চলার সময় পুলিশ সেখানে ছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০১:৫১
Share:

এক জন জনপ্রতিনিধি গুলি-খুন-রেপ করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন! সে কথা সামনে আসার পর কয়েক দিন কেটে গেলেও রাজ্য ও জেলা প্রশাসন তা নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি!

Advertisement

যে এলাকায় ওই সব কথা বলেছেন তাপসবাবু, তা নাকাশিপাড়া ও তেহট্ট থানার অন্তর্গত। কাছেই ফাঁড়ি। পরপর তিন জায়গায় সভা চলার সময় পুলিশ সেখানে ছিল। তবু ওই বক্তব্য নিয়ে কিছু বলতে নারাজ নাকাশিপাড়া ও তেহট্ট থানার ওসি।

মুখ খোলেননি সংশ্লিষ্ট মহকুমা শাসক, জেলার এসপি, জেলাশাসকও। যে বক্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নবান্নে চিঠি পাঠিয়েছে, সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিজি জিএমপি রেড্ডি, আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। তাপসের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর গত কয়েক দিনে যত বার এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছে, প্রত্যেক বার উত্তর এসেছে, “এ নিয়ে মন্তব্য করব না।”

Advertisement

আমলারা সংবাদমাধ্যমের কাছে মন্তব্য না-ও করতে পারেন। সেটা তাঁদের ইচ্ছা-নির্ভর। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু আইন মেনে প্রশাসন পরিচালিত হয়। কোনও ব্যক্তি প্রকাশ্যে অশোভন আচরণ করলে ও উস্কানিমূলক কথার্বাতা বললে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রকাশ্যে মারধর-খুন-ধর্ষণ-আক্রমণের কথা শুনলেও প্রশাসনের বড় কর্তারা কিছু বলেন না কেন? তাঁদের কি সত্যিই কিছু বলার নেই?

জনান্তিকে অনেক অফিসারই বলছেন, বলার বা করার অনেক কিছুই থাকে। কিন্তু সবার উপরে থাকে ‘রাজনৈতিক চাপ’, যার দ্বারা অফিসারেরা পরিচালিত হন। শুধু এই আমল নয়, সব আমলেই তা সত্য। অথচ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে না পারার জন্য বহু ক্ষেত্রে আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় অফিসারদেরই। আবার মুখ খুলে সরকারের বিরাগভাজন হলে ‘শাস্তির খাঁড়া’ও নেমে আসে এই অফিসারদের উপরেই। অতীতে স্বরাষ্ট্র সচিব থাকাকালীন প্রসাদরঞ্জন রায়কে ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। এই আমলে কলকাতার পুলিশ কমিশনার আর কে পচনন্দা, আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেন বা স্বরাষ্ট্র দফতরে সাধারণ অফিসার বিস্ময় রায়কেও ‘রোষের’ মুখে পড়তে হয়েছে।

যাঁরা সরকারের বিভিন্ন পদে রয়েছেন তাঁদের একাংশের বক্তব্য, শাসক দল কী চাইছে, সেটা বুঝেই সাধারণত অফিসারেরা প্রতিক্রিয়া দেখান। এবং এটাই হওয়া উচিত। বিশেষত ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবে রাজনীতির যোগ থাকলে ক্ষমতায় থাকা দল বিষয়টিকে কী চোখে দেখছে, সেটা বুঝেই অফিসারদের এগোনো উচিত। প্রশাসনের অন্য একটি অংশ অবশ্য তা মনে করে না। তাদের বক্তব্য, সরকার-বিরোধী বিষয় আর আইনশৃঙ্খলাজনিত ঘটনা এক নয়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে যাঁরা রয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কোনও ঘটনা হলে অবশ্যই তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া উচিত। না হলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে, এমন কিছু হলে অবশ্য বাম আমলেও প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা সেটা এড়িয়ে চলতেন। তবে সেটা এখনকার মতো এতটা প্রকট ছিল না বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। প্রাক্তন ডিজি ভূপিন্দর সিংহের কথায়, “এটা নির্ভর করে সরকাররের নীতির উপর।” কী রকম? প্রাক্তনরা বলছেন, অতীতেও সরকারকে বাঁচিয়ে চলার দায় ছিল। কিন্তু কোনও ঘটনা ঘটলে একেবারে মৌনব্রত নেওয়ার দরকার পড়ত না। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু না বললেও প্রশাসন কী করছে, সেই তথ্যটুকু অবশ্যই জানানো হতো। প্রাক্তন মুখ্য সচিব অশোকমোহন চক্রবর্তীর কথায়, “এখন কী হয় বলতে পারব না। তবে বড় ঘটনা হলে আমাদের সময় সংশ্লিষ্ট কেউ এক জন অন্তত বলতেন।” কলকাতার প্রাক্তন সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায় বলছেন, “এটা নির্ভর করে সরকার তার অফিসারদের কতটা স্বাধীনতা দিচ্ছে তার উপর। শাসক দলের চরিত্র ও ধরন দেখে অফিসারেরা বুঝে যান কতটা, কী বলতে হবে।”

অশোকমোহনবাবুর মতে, কোনও ঘটনা নিয়ে সকলে বললে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। তাই দায়িত্বশীল কোনও এক জনের বলা উচিত। এটাই প্রথা। “আমার সময় আমি, স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিজি, কেউ এক জন বলতেন” বক্তব্য অশোকমোহনের। প্রায় একই বক্তব্য প্রাক্তন ডিজি-র, ‘‘আমার সময় কিছু ঘটলে তা বলার দায়িত্ব ছিল এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)-র উপর।” প্রাক্তন এক কর্তার কথায়, আগের আমলে মাওবাদীদের কার্যকলাপ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কাছে মুখ খুলতেন ডিজি। আবার, নেতাইয়ে গুলিচালনার খবর পরের দিনই সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্য সচিব সমর ঘোষ। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের বক্তব্য জানাতেন কোনও পুলিশ কর্তা।

এখানেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরী, বা সিপিএম নেতা গৌতম দেব ও সুজন চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন অতি সক্রিয়তা দেখাবে আর এক জন সাংসদের প্রকাশ্য হুমকি শুনেও কর্তারা মুখে কুলুপ, কানে তুলো গুঁজে থাকবেন? সরকারের মনোভাব যাই হোক, চেয়ারের সম্মান তো তাঁদেরও দেওয়া উচিত। বর্তমান প্রশাসনের একাধিক অফিসারের বক্তব্য, পরিস্থিতি এখন অনেক খারাপ। এখন সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া দূর, স্রেফ কথা বললেই শাস্তি পেতে হতে পারে। শাস্তি মানে বদলি, নানা ভাবে হেনস্থা।

অতএব, মুখ বন্ধ। প্রকাশ্যে কেউ ধর্ষণ-খুন-গুলি করে মেরে ফেলার হুঙ্কার দিলেও ‘নো কমেন্ট’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন