ঘর থেকে দরজা, এ-ই পৃথিবী দুই ভাইবোনের

দীপাবলির রাতে আশপাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চারা মিলে বাজি পোড়াচ্ছে। তেরো বছরের ছেলেটি ওদের মধ্যে নেই। পাড়ায় দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নতুন পোশাক পরা কিশোরীরা যখন হরেক মজায় মাতোয়ারা, পনেরো বছরের মেয়েটিকে তাদের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের বয়সী ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গেলেও তেরো-পনেরোর দু’ভাই-বোনের সে পাট চুকে গিয়েছে। দু’জনের পৃথিবী বলতে ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে ঘেরা চৌহদ্দিটুকু। ঘর থেকে দরজা। দরজার ও-পারের জগৎ থেকে ওরা যেন বিচ্ছিন্ন।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৫
Share:

দীপাবলির রাতে আশপাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চারা মিলে বাজি পোড়াচ্ছে। তেরো বছরের ছেলেটি ওদের মধ্যে নেই।

Advertisement

পাড়ায় দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নতুন পোশাক পরা কিশোরীরা যখন হরেক মজায় মাতোয়ারা, পনেরো বছরের মেয়েটিকে তাদের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের বয়সী ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গেলেও তেরো-পনেরোর দু’ভাই-বোনের সে পাট চুকে গিয়েছে।

দু’জনের পৃথিবী বলতে ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালে ঘেরা চৌহদ্দিটুকু। ঘর থেকে দরজা। দরজার ও-পারের জগৎ থেকে ওরা যেন বিচ্ছিন্ন।

Advertisement

এক বছর আগে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়া ইস্তক এ ভাবেই দিন কাটছে তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের দুই সন্তানের। সল্টলেকে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এখন যারা বাগুইআটির নারায়ণতলায় দিদিমার হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। বুধবার রাতে তাদের মা, অর্থাৎ সুদীপ্তের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি গ্রেফতার হওয়ার পরে দিদিমাই আগলে রেখেছেন ভাই-বোনকে।

এলাকার কেউ অবশ্য পরিবারটিকে তেমন চেনেন না। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি)-এর হাতে পিয়ালির ধরা পড়ার খবর চাউর হওয়ায় পড়শিদের অনেকে তাঁদের পরিচয় জানতে পেরেছেন। তা নিয়ে বৃহস্পতিবার পাড়ায় দস্তুরমতো কানাঘুষোও চলেছে। ওই বাড়িরই একতলার বাসিন্দা মাঝবয়সী মহিলার বিস্মিত প্রতিক্রিয়া, “জানতাম না যে, ওরা সুদীপ্ত সেনের ছেলে-মেয়ে। নামও জানি না। কারও সঙ্গে তো মেশে না! ওদের মা-কেও দেখিনি কারও সঙ্গে মিশতে।” আর এক পড়শির কথায়, “এই তো ফ্ল্যাটে কালীপুজো হল, পাড়ায় দুর্গাপুজো হল। ওরা ঘর থেকে বেরোয়নি!”

সারদা-কাণ্ডে সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পরে পিয়ালি দু’ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সল্টলেকের বাড়ি ছাড়েন। এসে ওঠেন মায়ের এই ফ্ল্যাটে। এবং সেই থেকে তাঁরা নিজেদের কার্যত ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন। এ দিন দুপুরে গিয়ে ডাকাডাকি করায় এক বৃদ্ধা ফ্ল্যাটের দরজা সামান্য খুললেন। নিজেকে সুদীপ্তের শাশুড়ি হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানালেন, এখানে এসে ওঠার আগে তাঁর নাতি-নাতনি কলকাতার নামি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। মেয়ে ছিল ক্লাস এইটে, ছেলে সেভেনে। এখন সব কিছু অন্য রকম। কী রকম?

বৃদ্ধা বলেন, “ওরা আর স্কুলে যায় না। বাবা সম্পর্কে খারাপ কথা কারই বা ভাল লাগে? এ সব শুনতে শুনতে ওরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল।” তা হলে পড়াশুনো?

বৃদ্ধা জানান, তাঁর নাতি-নাতনি আপাতত বাড়িতে থেকে দূরশিক্ষার মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। “কিন্তু দু’জনেরই স্বভাব পাল্টে গিয়েছে। ঘর থেকে বার হয় না। দুর্গাপুজো, কালীপুজোয় ফ্ল্যাটের অন্য বাচ্চারা যখন আনন্দ করে, তখনও চুপ করে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে।” আক্ষেপ করেন দিদিমা।

দরজার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা গেল, দু’বেডরুমের ছিমছাম ফ্ল্যাট। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের যেমন থাকে। দরজায় লক্ষ্মী-গণেশের ছবি। বসার ঘরে সোফা। ফ্রিজের উপরে ফোটোস্ট্যান্ডে মায়ের সঙ্গে বাচ্চাদের ছবি। ফ্রেমে অবশ্য সুদীপ্ত নেই।

বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপ করাবেন না? “থাক না। ওরা কারও সঙ্গে আলাপ করে না। লজ্জা পায়।” বিব্রত উত্তর বৃদ্ধার। বললেন, “এখন তো ওদের মা’কেও পুলিশ নিয়ে গেল! ওরা শুধু আমায় জিজ্ঞেস করছে, মা কখন ফিরবে?”

দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভিতর থেকে ভেসে আসছে টেলিভিশনের আওয়াজ। কার্টুন চ্যানেল চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন